বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় এক অতুলনীয় রাষ্ট্রনায়কের কথা
সাম্প্রতিক পৃথিবীতে এক উন্নয়নকামী দেশের রাষ্ট্রনায়ক স্বদেশ এবং বিশ্বমঞ্চ উভয় ক্ষেত্রেই এক অসামান্য ও অনন্যসাধারণ নেতৃত্ব প্রদান করছেন। তিনি হচ্ছেন জননেত্রী দেশরত্ন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু-দুহিতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি অত্যন্ত দুরূহ ও সংকটাকীর্ণ সময়ে তিনি দেশ এবং দেশবাসীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যথাযোগ্য উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করছেন এবং যুগপৎ বিশ্বমঞ্চেও দেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অতীব মর্যাদাপূর্ণ এক আসনে। বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত লক্ষ্য ধ্রুবতারার মতোই তাঁকে দিচ্ছে সঠিক দিকনির্দেশনা। উদ্দেশ্য সাধনে নীতিনিষ্ঠ তিনি জানেন, বর্তমানের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গৃহীত কোনো নীতি আমেরিকার স্বার্থবিরোধী বলে প্রতিভাত হলে বহুধা সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। কিন্তু আমাদের নেত্রী তাতে শঙ্কিত বা ভীত নন। বিশ্বমঞ্চে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্বিপাক মোকাবিলায় দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামে তিনি নির্ভয়, সোচ্চার। বিশ্বব্যাংকের ভিত্তিহীন অনুযোগ বা সহায়তা প্রদানে ব্যর্থতায় হতোদ্যম না হয়ে নিজ সম্পদে এগিয়ে গিয়ে বাস্তবায়িত করেছেন পদ্মা সেতু প্রকল্প। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে মানবিক কারণে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিয়েছেন অনবদ্য সহায়ক এক ভূমিকা।
উন্নয়ন অভিযাত্রা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ তিনি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নয়নমুখী যেসব কর্মকাণ্ড হচ্ছে, তা অভূতপূর্ব। নগরীতে চালু হয়েছে মেট্রোরেল, স্থাপিত হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। চালু হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ঢাকা থেকে দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সড়কপথে যাওয়া আজ মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। শহর বা গ্রাম; চোখ মেললেই দেখা যায় সার্বিক উন্নয়নের দীপ্ত স্বাক্ষর। জীবনযাপনের ধারা ও মানেও এসেছে ইতিবাচক বিরাট পরিবর্তন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকন্যা শুধু বাংলাদেশের নির্বাচিত সফল প্রধানমন্ত্রীই নন; তিনি বিশ্ববরেণ্য এক জননেত্রী। আধুনিক পৃথিবীতে বাঙালির পথপ্রদর্শক।
বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে এ.আর. রহমানের সুরোপিত গানের চরণগুলো স্মরণ করি– পিতা দিয়েছেন স্বাধীন স্বদেশ, কন্যা দিয়েছেন আলো। বাস্তবিকই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আলোকবর্তিকা হাতে দেশপ্রেম ও মানবপ্রীতির চেতনা ধারণ করে উন্নয়নের মহাসড়কে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এক লক্ষ্য থেকে উন্নততর আরেক লক্ষ্যে।
তাঁর যাত্রাপথ ছিল বিপৎসংকুল, সমস্যা-আকীর্ণ। পদে পদে মৃত্যুভয়। গুলিবর্ষণ, বোমা বিস্ফোরণ, চোরাগোপ্তা হামলা, গ্রেনেড আক্রমণ– এত মারণঘাত অতিক্রম করেই তাঁকে বাঁচতে হয়েছে; এগোতে হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্রনায়ককে জীবনে এত বাধা-বিপত্তি, নিধন-চক্রান্ত, মর্মন্তুদ পারিবারিক ট্র্যাজেডির শিকার হতে হয়নি। এ তুলনাহীন সংগ্রামী জীবনে তিনি যে শুধু সর্বজননন্দিত নেত্রী ও দিকনির্দেশক রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন, তাই নয়; তিনি হয়ে উঠেছেন চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ, ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’– মানবতার জননী।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালের ভয়াবহ সেই চরম শোকাবহ ট্র্যাজেডি যখন হলো, কতই বা ছিল তাঁর বয়স! ২৮। মাত্র ২৮। ভাবলে বিস্ময়াভিভূত হতে হয়– কী করে আশ্চর্য এ অতিচেনা আমাদেরই মেয়ে; ২৮টি বছর যার প্রতিটি পাথরে ঠোকা খেয়ে অত্যন্ত শঙ্কিত বুকে জীবনের পদ্মকে ফোটাল; সে মেয়ে কেমন করে তার দুটি চোখে এত আলো নিয়ে পৃথিবীর রুক্ষ পথে যাত্রা করল একাকী! এ-কথা যতই ভাবি, অবাক হয়ে যাই।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথমে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে; পরে ২০০৯-২০০১৪, ২০১৪-২০১৮ এবং ২০১৮-২০২৩– টানা এই তিন মেয়াদে সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিকল্পিত উন্নয়ন হয়েছে।
কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বকালীন সরকারের কৃষি ও কৃষকবান্ধব নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের কল্যাণে সংশ্লিষ্ট সর্বক্ষেত্রে বিন্যস্ত উন্নয়ন হয়েছে। কৃষকের নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সর্বক্ষেত্রে বেড়েছে উৎপাদন; গবেষকরাও উদ্ভাবন করেছেন অনেক নতুন প্রযুক্তি। বিনিয়োগ, যাতায়াতের সুবিধা ও নিশ্চয়তা প্রদান করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।
ক্ষমতা গ্রহণ করেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সূচনা করলেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন– ‘আমার দেশের প্রত্যেক মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে– এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন।’ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলাই হয়ে দাঁড়াল দেশরত্ন শেখ হাসিনার অনড় লক্ষ্য। সব মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তাঁর সরকার দারিদ্র্য বিমোচন ও ক্ষুধামুক্তি, যুগোপযোগী শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তা, জনগণের দোরগোড়ায় ডিজিটাল সেবা এবং বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছানো, পরিবেশ সুরক্ষা, দেশি-বিদেশি বিনিযোগ বৃদ্ধি এবং নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১০টি বিশেষ উদ্যোগ এবং ১০টি বৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেন। সবচেয়ে সন্তুষ্টির কথা, এ উদ্যোগ ও প্রকল্প প্রণয়ন কাগজ-কলমে বা প্রস্তুতিকালীন ব্যবস্থা গ্রহণে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রতিটি বিষয়ই অগ্রাধিকার পেয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টায় সূচি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে। আমরা তার প্রত্যক্ষদর্শী।
‘একটি বাড়ি একটি খামার’– দিন বদলের এই বৈপ্লবিক চিন্তা ও লক্ষ্য অর্জন এবং আশ্রয়ণ প্রকল্প তো বাংলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য শেখ হাসিনার লক্ষ্যাদর্শভিত্তিক অতুলনীয় উপহার। উন্নয়ন অর্থনীতির সঙ্গে দেশ-বিদেশে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থায় দীর্ঘ সংশ্লিষ্টতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, পৃথিবীর কোথাও গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নকে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে গ্রহণ করে এ জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কোনো উন্নয়নকামী দেশে ঘটেনি। এটাই তো সত্যিকারের প্রাথমিক মানবাধিকার।
একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় গড়ে উঠেছে হাজার হাজার গ্রাম-উন্নয়ন সমিতি এবং তারা কাজ করছে ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’-এর সহযোগী হিসেবে। প্রকল্পের উপহারভোগীরাই এ ব্যাংকের ৪৯ শতাংশের মালিক। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজস্ব পুঁজি গঠন এবং বিনিয়োগে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীবিকায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও টেকসই উন্নয়ন। উন্নয়ন পরিবেশবান্ধব এবং যুগোপযোগী করার জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় দুর্যোগ সহনীয় বাড়ি নির্মাণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণে ‘সোলার প্যানেল’ স্থাপন, বৃক্ষরোপণ, পুকুর খনন, টেকসই সংযোগ সড়ক ও কালভার্ট নির্মাণ লক্ষ্যানুযায়ী করা হচ্ছে।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়ন করে দেশ ও দেশবাসীর অগ্রগতিকে সুগম করেছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় হয়েছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। প্রচলিত উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ, উইন্ডমিল ও বায়োগ্যাস থেকেও হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। দেশে প্রথমবারের মতো শুভারম্ভ হচ্ছে পরমাণু বিদ্যুতের উৎপাদন।
কয়েকটি বৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন দেশকে আজ শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে নিয়ে গেছে উন্নয়নের মহাসড়কে। এসবের মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল প্রকল্প, সোনাদিয়া ও পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি পার্ক ও ভিলেজ, আইটি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার স্থাপনের লক্ষ্যে হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ গঠন। কর্ণফুলী নদীতলে টানেল নির্মাণ, শিল্পায়নের জন্য রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের উন্নয়ন সাধন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিকরণ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টির পরিকল্পনা। এর মধ্যে অনেক প্রকল্পই বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অন্যগুলোতে শুধু প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড নয়, বাস্তবায়নেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করতে চান শেখ হাসিনা। তাঁর উদ্যোগেই দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি হয়। ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হয়েছে। যদিও এখন মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বাস্তবায়িত হয়নি। ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত রয়ে গেছে আমাদের ন্যায্য প্রাপ্তি তিস্তা ও অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন চুক্ত; রীতিসম্মত বাণিজ্যিক আনুকূল্য ও সীমান্তে বাঙালি হত্যা। দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে আলোচনার ভিত্তিতেই সমাধানে সচেষ্ট।
ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট বা দুর্বিপাক মোকাবিলায় শেখ হাসিনার রয়েছে অসামান্য দক্ষতা ও নৈপুণ্য। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করে তিনি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। তিনি করেছেন বিডিআর বিদ্রোহের শান্তিপূর্ণ সমাধান। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিকালে তাঁরই দূরদর্শী পরিচালনায় বাংলাদেশে তূলনামূলক সহনীয় অবস্থা বিরাজ করে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতার উদ্বেগজনক উত্থান সত্ত্বেও বাংলাদেশ রয়েছে পুরো অসাম্প্রদায়িক। সন্ত্রাস দমনে হাসিনা সরকারের সফল নীতির প্রশংসা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। গত ১ ডিসেম্বর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘কান্ট্রি রিপোর্টস অব টেরোরিজম ২০২২-বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তা প্রকাশিত হয়। এসব ক্ষেত্রে গৃহীত নীতি হচ্ছে ‘নো টলারেন্স’।
সংবিধান অনুযায়ী একটি সুন্দর, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের অধীন, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় শিগগিরই হতে যাচ্ছে দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচন। শেখ হাসিনা ও তাঁর পরীক্ষিত নেতৃত্বে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে আবার উন্নয়নের ধারাকে চলমান রাখবে– এটাই উজ্জীবিত ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বাঙালির প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা স্থাপনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিবেদিত প্রাণ বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বের আর কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প নেই।





