ভারত-অস্ট্রেলিয়া ফাইনালের মহারণ আজ
বিশ্বকাপ ফাইনালের মহারণ আজ। সুপার সানডেতে ওয়ানডে ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে শিরোপা জিতে গেলে টুর্নামেন্টে ষষ্ঠবারের মতো সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করবে অস্ট্রেলিয়া। তবে অজিদের সামনে এবার কঠিন পরীক্ষা। প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকছে ঘরের মাঠে অপ্রতিরোধ্য ভারত। কে হবে ক্রিকেটের নতুন রাজা? রাতে বিজয়ীর মঞ্চে থাকবে ভারত, না অস্ট্রেলিয়া, সেই অংকের উত্তর মিলবে ব্যাট-বলের কঠিন লড়াই শেষে।
সর্বোচ্চ পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া ১৯৮৭, ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭ ও ২০১৫ সালে। অন্যদিকে ভারত জিতেছে দুইবার ১৯৮৩ ও ২০১১ সালে। ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে নিজেদের তৃতীয় শিরোপা অর্জন করেছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই ম্যাচে অজিরা দুই উইকেটে ৩৫৯ করেছিল। ভারত ২৩৪ রানে অলআউট হয়ে শিরোপা বঞ্চিত হয়।
সেই বিষাদের স্মৃতি ভুলতে বিশ্বকাপের ত্রয়োদশ আসরের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে ভারত। রোববার আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে গড়াবে শিরোপার মহারণ। বাংলাদেশ সময় দুপুর আড়াইটায় শুরু হবে লড়াই। ম্যাচটি ঘিরে বর্ণিল আয়োজনে মেতে উঠবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ১ লক্ষ ৩০ হাজার দর্শকের সামনে অবশ্য অনেকটা এগিয়ে থাকবে ভারত।
টানা ১০ ম্যাচ জয়ে অপরাজিত থেকেই ফাইনালে পৌঁছেছে ভারত। ঘরের মাঠের ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং সব বিভাগেই ঠিকঠাক কাজ করছে রোহিত শর্মার দল। বল হাতে প্রতিপক্ষদের অল্প রানেই গুটিয়ে দিয়েছেন, আর ব্যাট হাতে ছিল রান বন্যা। ভারতের সব ব্যাটারই রয়েছেন দুরন্ত ফর্মে, সবমিলিয়ে ২৬৪টি চার এবং ৮৯টি ছক্কা মেরেছেন তারা। ১০ ম্যাচে মোট ২৯২০ রান করেছে রোহিত-কোহলিরা। নিয়মিত পারফর্ম করছেন ওপেনিংয়ে নামা রোহিত ও শুভমন গিল।
আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহাকের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন বিরাট কোহলি। ১০ ম্যাচ খেলে তিন সেঞ্চুরি ও চার ফিফটিতে তার সংগ্রহ ৭১১ রান। সেরা পাঁচে রয়েছেন ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মাও। এক সেঞ্চুরি ও তিন ফিফটিতে ৫৫০ রান করে রয়েছেন পাঁচে। আসরে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে সেঞ্চুরি হয়েছে ৩৯টি, এরমধ্যে ভারতীয় ব্যাটারদের সেঞ্চুরির সংখ্যা ৭টি। সবমিলিয়ে ১৬ ফিফটির দেখা পেয়েছে তারা। চার, পাঁচ বা ছয়ে রান পাচ্ছেন শ্রেয়াস আয়ার, লোকেশ রাহুল, সূর্যকুমার যাদবরা।
বল হাতে আরও দুর্দান্ত ভারতের পেসাররা। ৪ ম্যাচ কম খেলেও অন্যদের ছাড়িয়ে গেছেন ডানহাতি পেসার মোহাম্মদ শামি। ৬ ম্যাচ খেলেই আসরে ৯.১৩ গড়ে সর্বাধিক ২৩ উইকেটের মালিক হয়েছেন তিনি। তিনবার পাঁচ কিংবা তার অধিক উইকেট তুলে নিয়েছেন। সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করেছেন ক্যারিয়ার সেরা বোলিং। ৫৭ রানে ৭ উইকেট তুলেছেন ৩৩ বর্ষী।
দুর্দান্ত করছেন জাসপ্রীত বুমরাহও। ১০ ম্যাচে নিয়েছেন ১৮ উইকেট। কম যাননা মোহাম্মদ সিরাজ, রবীন্দ্র জাদেজা বা কুলদীপ যাদবরাও। ফাইনালে তাদের মোকাবেলা কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে অস্ট্রেলিয়ার টপঅর্ডার ব্যাটারদের জন্য। নিয়মিত পারফর্ম করে যাচ্ছেন বাঁহাতি স্পিনিং অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজাও। ১০ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ১৬ উইকেট। চার ইনিংসে ব্যাট করে করেছেন ১১১ রান।
আইসিসির যে কোনো আসর আসলেই বাঘের হুঙ্কার দিয়ে উঠে অস্ট্রেলিয়া। আইসিসির টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ, ওয়ানডে বিশ্বকাপ, টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিসহ সকল ধরণের ট্রফিজয়ী একমাত্র দল অস্ট্রেলিয়া। সবশেষ ২০১৫ সালে ঘরের মাটিতে বিশ্বকাপ জেতা দলটি আবারও পৌঁছেছে ফাইনালে। ঘরের মাঠে ভারতকে হারিয়ে হেক্সা জয় করতে বদ্ধপরিকর দলটি। আসরে ১০ ম্যাচ খেলে সবমিলিয়ে ২৮৪৬ রান করেছে অজিরা।
ব্যাট হাতে দুরন্ত ফর্মে রয়েছেন ডেভিড ওয়ার্নার ও মিচেল মার্শ। ৫২৮ রান করা ওয়ার্নারের অবস্থান সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকার ছয়ে। চার ও ছক্কা মারার দিক থেকে অন্যসব ব্যাটার থেকে এগিয়ে ওয়ার্নার, মেরেছেন ৪৯টি চার ও ২৪টি ছক্কা। নয়ে আছেন ডানহাতি টপঅর্ডার মার্শ জন্মদিনে সেঞ্চুরি পাওয়া এ তারকা আসরে দুটি সেঞ্চুরি পেয়েছেন। একটি ফিফটিতে তার মোট রান ৪২৬, সর্বোচ্চ ১৭৭ নটআউট। চার ছক্কায় কমও যান না, মেরেছেন ৪২টি চার ও ২০টি ছক্কা। নিয়মিত রান পাচ্ছেন ট্রাভিস হেডসহ অন্যান্যরাও। ভারতের বিপক্ষে ভালো কিছু করতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে পুরো অস্ট্রেলিয়া।
দুই ম্যাচ হারের পর ফাইনালে আনতে কম যাননি অস্ট্রেলিয়ার বোলাররাও। দুর্দান্ত পারফর্ম করে যাচ্ছেন লেগস্পিনার অ্যাডাম জাম্পা। আসরে এখন পর্যন্ত ১০ ম্যাচ খেলে ২২ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহকের তালিকায় দুইয়ে আছেন তিনি। কার্যকরী বোলিং করে এসেছেন পেসার জশ হ্যাজেলউড। ১০ ম্যাচ খেলা এ ডানহাতি ১৪ উইকেট নিয়েছেন। গত দুই আসরের সর্বাধিক উইকেট শিকারী মিচেল স্টার্ক ও প্যাট কামিন্সও কম যান না। দুজনে নিয়েছেন সমান ১৩টি করে উইকেট।
বেশ ভালোই রান পাচ্ছেন স্পিনিং অলরাউন্ডার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। আসরে দুটি সেঞ্চুরি পেয়েছেন, যার মধ্যে একটি ডাবল সেঞ্চুরিও রয়েছে। ৮ ম্যাচ খেলা ম্যাক্সওয়েল বোলিংয়েও নিয়েছেন ৫ উইকেট, ইকোনোমি সাড়ে চারের একটু বেশি।
ফাইনাল মহারণের আগে অবশ্য আবহাওয়ার কথা মাথায় রাখতে হচ্ছে দুই দলের। এ সময়টাতে ভারতের নানা স্থানে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকে। বিশ্বকাপের চলতি আসরে বেশ কয়েকটি ম্যাচেই বৃষ্টি হানা দিয়েছিল। তবে দেশটির আবহাওয়া অধিদপ্তর দুই দলকেই কিছুটা আশ্বস্ত করেছে।
পূর্বাভাস বলছে, গুজরাট শহরের স্টেডিয়ামটির আশেপাশের অঞ্চলে রোববার বৃষ্টির সম্ভাবনা বেশ কম। তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকতে পারে। সন্ধ্যায় ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামতে পারে। বাতাসের আর্দ্রতা ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে সন্ধ্যা থেকে স্টেডিয়ামে কুয়াশার আধিক্য থাকতে পারে। যে কারণে ফিল্ডিংয়ে থাকা দল সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। পরে ব্যাটিং করা দল পাবে বাড়তি সুবিধা।
দুই দলের মুখোমুখির দীর্ঘ পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে জয়ের পাল্লা ভারি অস্ট্রেলিয়ার দিকে। ১৫০ ওয়ানডেতে অজিদের ৮৩ জয়ের বিপরীতে ভারত জিতেছে ৫৭টিতে। বাকি ১০ ম্যাচ শেষ হয়েছে ফল ছাড়াই। তবে টাই হয়নি কোনো ম্যাচ।
৫৭ জয়ের মধ্যে ৩৩ ম্যাচে ঘরের মাঠে জয় পেয়েছে ভারত। প্রতিপক্ষের মাঠে ১৪টি ও নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ১০ জয় আছে আসরের স্বাগতিকদের ঝুলিতে। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়া নিজেদের মাটিতে জিতেছে ৩৮ ম্যাচ। ভারতের মাঠে ৩৩ ম্যাচ এবং নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ১২ জয় আছে প্যাট কামিন্সদের।
বিশ্বকাপের পরিসংখ্যানেও এগিয়ে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। ১৩ ম্যাচে তাদের ৮ জয়ের বিপরীতে দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতের জয় ৫টিতে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্কোর ৩৫২ ও ১২৫, অজিদের ৩৫৯ ও ১২৮ রান। বিশ্বকাপের ফাইনালে আগে একবার মুখোমুখি হয়েছিল দুদল, ২০০৩ সালে। যেখানে জিতে শিরোপা নিয়ে ফিরেছিল অস্ট্রেলিয়া।
মহারণে নামার আগে অবশ্য অজিদের পরিপূর্ণ শক্তিশালী দল হিসেবে মানছেন ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা। তবে অজিদের ঠেকাতে নিজেদের বোলিং ইউনিটের ওপর ভরসা রাখছেন তিনি।
ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে ‘আমরা জানি অস্ট্রেলিয়া কী করতে পারে। তারা খুবই পরিপূর্ণ দল। তারা কী রকম ফর্মে আছে তা নিয়ে আমরা চিন্তা করতে চাই না, বরঞ্চ আমরা কী করতে চাই সেদিকে মনোযোগ দিতে চাই। তবে টুর্নামেন্টে আমাদের বোলাররা দুর্দান্ত করেছে। আমি মনে করি, আমাদের যে কোনো একজনকে অন্তত ভাল ক্রিকেট খেলতে হবে। তাই ভারসাম্য রাখা গুরুত্বপূর্ণ।’
বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে কঠোর পরিশ্রম করেছে ভারতের ক্রিকেটাররা। সে জন্য অজিদের হারিয়ে নিজেদের তৃতীয় শিরোপা ঘরে তুলতে চান রোহিত নিজেও। বলেছেন, ‘আমি একই কথা বলতে চাই, এটি জিততে পারলে ভালো লাগবে। কারণ আমরা এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমরা জানি কিভাবে চাপ সামলাতে হয়। আমরা এখন পর্যন্ত যেভাবে খেলেছি তা চালিয়ে যেতে চাই।’
অন্যদিকে আহমেদাবাদে এক লাখ ৩২ হাজার দর্শক স্তব্ধ করে রাখতে চান অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। জানিয়েছেন, বড় মঞ্চে খেলার অভিজ্ঞতা তার দলের আছে। বলেছেন, ‘ভারতীয় সমর্থকদের সামনে এর আগেও আমরা খেলেছি, এখানকার সমর্থকদের গর্জে উঠা নতুন কিছু নয়। তবে নিজেদের সেরা ছন্দে থাকতে পারলে ডেভিড ওয়ার্নারের মতো কেউ ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারেন। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপজয়ী ৬-৭ জন খেলোয়াড় আছে এই দলে। তারা জানে কীভাবে বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চের চাপ সামাল দিতে হয় এবং সাহসী খেলাটা খেলতে হয়।’
‘ভারতের বিপক্ষে এটি দুর্দান্ত ম্যাচ হতে চলেছে। টুর্নামেন্টেও ভারত দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলছে। সমর্থকরা তাদের পাশেই থাকবে এবং একতরফা সমর্থন পাবে। তবে তাদের স্তব্ধ রাখাটাই হবে আমাদের জন্য সন্তোষজনক।’
বল হাতে দুর্দান্ত ফর্মে আছেন মোহাম্মদ শামি ও কুলদীপ যাদবরা। ব্যাট হাতে ভারতের সকলেই ভালো করছেন। বিরাট-রোহিত-গিল সকলেই দিচ্ছেন নিজের সেরাটা। দুর্দান্ত করা দলটি নিয়েই অজিদের বিপক্ষে নামতে পারে ভারত।
অন্যদিকে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে হার দিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার। এরপর টানা ৮টি ম্যাচ জিতে ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে প্যাট কামিন্সের দল। ফাইনালে একটি পরিবর্তন আনতে পারে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। মার্নাস লাবুশেনের জায়গায় একাদশে ঢুকতে পারেন পেস অলরাউন্ডার মার্কাস স্টয়নিস।
ভারতের সম্ভাব্য একাদশ: রোহিত শর্মা (অধিনায়ক), শুভমন গিল, বিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আয়ার, লোকেশ রাহুল (উইকেটরক্ষক), সূর্যকুমার যাদব, রবীন্দ্র জাদেজা, মোহাম্মদ শামি, জাসপ্রীত বুমরাহ, কুলদীপ যাদব ও মোহাম্মদ সিরাজ।
অস্ট্রেলিয়ার সম্ভাব্য একাদশ: ডেভিড ওয়ার্নার, ট্রাভিস হেড, মিচেল মার্শ, স্টিভেন স্মিথ, মার্কাস স্টয়নিস, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, জশ ইংলিশ (উইকেটকিপার), মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স (অধিনায়ক), অ্যাডাম জাম্পা ও জশ হ্যাজেলউড।