আন্দোলনকালে শিশুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনাগুলো দুর্ভাগ্যজনক এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া, যা করতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে।
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সভাকক্ষে শিশু অধিকার ও শিশুশ্রম বিষয়ক থিমেটিক কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শিশু নিহত ও আহতের ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম নিরসন, আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ নিয়ে চেয়ারম্যান বক্তব্যে প্রাধান্য দেন।
শিশুদের অধিকার সুরক্ষা, একটি স্বাভাবিক ও নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তা ও শিশুশ্রম নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা করা হয় সভায়। এ সময় শিশুদের বিভিন্ন রাজনৈতিক মিটিং, মিছিল ও নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার প্রতিরোধ করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে নয়, বাস্তবে এর প্রয়োগ দেখতে কার্যকর উদ্যোগের আহ্বান জানান আলোচকরা।
আলোচনাকালে কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্রকে প্রতিটি ঘটনা পৃথকভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনাপূর্বক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে শিশু সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আন্দোলনকালে সহিংসতায় শিশুদের ওপর যেসব নেতিবাচক শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়েছে, তা দ্রুত কাটিয়ে উঠার উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, সেসব দ্রুত নিরসন ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আহত শিশুদের তালিকা ও বিবরণ প্রস্তুত করে দ্রুত তাদের যথাযথ চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। নিহতদের পরিবারকে সামাজিক সুরক্ষা প্রদানে সহায়ক ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ রোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এসডিজির ৫.৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বাল্যবিবাহ ও জোরপূর্বক বিবাহ নিরসনে যে অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সে বিষয়ে লক্ষ্যনির্ভর ও সুনির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক কর্মপন্থা নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহ হারের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষ সারিতে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ের হার ৫১ শতাংশ, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বাধিক। বাল্যবিবাহের বহুমাত্রিক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। প্রচলিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি এবং মনস্তত্ত্ব বিদ্যমান রেখে শুধু আইন প্রণয়নে বাল্যবিবাহ নিরসন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমাদের একেবারে প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে জনগণকে সচেতন করতে হবে। বাল্যবিবাহ নির্মূলে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ইতিবাচক ধারণা সৃজন করতে হবে। ধারণাগুলো সমাজের সব স্তরে অনুধাবন ও প্রতিপালনের মতো করে গ্রহণের জন্য মানসিকতা তৈরিতে ব্রতী হতে হবে।
অন্যদিকে বিদ্যমান শ্রম আইনের বিভিন্ন দিক বিবেচনাপূর্বক এটি সংশোধন ও আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানান চেয়ারম্যান। শিশুশ্রমের জন্য বয়স ও কর্মঘণ্টা বিষয়ক আইনের বিদ্যমান বিতর্ক নিরসনপূর্বক সরাসরি শ্রমে নিয়োজন ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম হতে বিরত থাকার বিষয়ে বিধান রাখার প্রতি গুরুত্ব প্রদানের আহ্বান জানান তিনি।
অন্যদিকে, কমিশন ইতোমধ্যে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইনের খসড়া ও গৃহকর্মী (কল্যাণ ও সুরক্ষা) আইনের খসড়া মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে। এই আইনের কার্যকর ব্যবহার শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন চেয়ারম্যান।
উল্লেখ্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও একাধিক বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে কক্সবাজারের রামুর দুর্গম এলাকায় চারটি গ্রাম, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার কয়েকটি গ্রামসহ তিন উপজেলার কয়েকটি নয়টি গ্রাম বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
পাশাপাশি, এক হাজারের ৩২৩টি গ্রাম বর্তমানে বাল্যবিবাহমুক্ত করার ঘোষণার জন্য প্রস্তাবিত রয়েছে। এগুলো কমিশন গভীর অভিনিবেশ সহকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এ লক্ষ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিয়মিত সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা নিয়ে সভা ও সেমিনার আয়োজন করে যাচ্ছে, যাতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে বাল্যবিবাহ নিরোধ করতে পারে।
মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ড. তানিয়া হকের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন কমিশন সদস্য কংজরী চৌধুরী, অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, ইউনিসেফের প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রতিনিধি, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি, সেইভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিনিধি ও ইনসিডিন বাংলাদেশের প্রতিনিধি, শিশু প্রতিনিধি এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রতিনিধি ও শ্রম অধিদপ্তরের প্রতিনিধি।