হাদির ওপর গুলি চালানো শ্যুটারকে ‘ভারতের স্বার্থরক্ষাকারী’ আখ্যায়িত করে প্রশংসা
অনলাইনে ও মোবাইল ফোনে ধারাবাহিক হত্যার হুমকির মধ্যেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুজন ব্যক্তি তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর অবস্থায় তিনি বর্তমানে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এই হত্যাচেষ্টার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র উদ্বেগ দেখা দেয়। সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘটনার নিন্দা জানালেও, এর বিপরীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্নধর্মী প্রতিক্রিয়া ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানোর অভিযোগ উঠেছে।
স্বাধীন অনুসন্ধানী গণমাধ্যম দ্য ডিসেন্ট–এর অনুসন্ধানে দাবি করা হয়, ভারত থেকে পরিচালিত একাধিক হিন্দুত্ববাদী অনলাইন অ্যাকাউন্ট ও আওয়ামী লীগপন্থী অ্যাক্টিভিস্টরা হামলার ঘটনাকে সমর্থন করে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে হামলাকারীদের ভারতের স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রশংসা করা হয়।
ভারতের সাবেক সেনাকর্মকর্তা এবং ভারতীয় ক্যাম্পেইন গ্রুপ Youth4Nation – TN Chapter-এর সাধারণ সম্পাদক মেজর মাধান কুমার (অব.) এক্স পোস্টে দাবি করেছেন, ওসমান হাদী ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল দখল করে ‘গ্রেটার বাংলাদেশ’ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং ঢাকায় অজ্ঞাতনামাদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
মেজর মাধান কুমারের সাম্প্রতিক এক্স পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিনি ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপির) পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
অনুসন্ধানে আরও বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ভারতীয় কয়েক ডজন অ্যাকাউন্ট থেকে সমন্বিতভাবে দাবি ছড়ানো হয় যে, ওসমান হাদি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল দখল করে ‘গ্রেটার বাংলাদেশ’ গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন—যার কোনো প্রমাণ নেই। এই দাবির পক্ষে তার একটি ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়। তবে যাচাইয়ে দেখা গেছে, পোস্টে ব্যবহৃত মানচিত্রে বাংলাদেশ ও ভারত আলাদা রঙে চিহ্নিত ছিল।
এ ছাড়া #Dhurandhar হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে হামলাকে সমর্থন জানানো হয়। হ্যাশট্যাগটি একটি বলিউড স্পাই চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও, এটিকে ব্যবহার করে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বললে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।
ভারতীয় অ্যাকাউন্ট BhikuMhatre এক এক্স পোস্টে একই দাবি করেন। এছাড়াও তিনি দাবি করেন, ভারতীয়রা কিছু #Dhurandar-এর জন্য নিরাপদ আছে। পোস্টটির সঙ্গে তিনি একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্য যুক্ত করেন, যেখানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’–কে প্রশংসা করা হয়।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী অ্যাকটিভিস্ট এবং বিজেপির ক্যাম্পেইনার ড. রাজেশ পাটিল এক দীর্ঘ পোস্টে ওসমান হাদীর তথাকথিত ভারত দখলের মনগড়া পরিকল্পনা বর্ণনা করে দাবি করেন, একজন #Dhurandar হাদীকে তার ভারতবিরোধিতার জন্য হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়াও তিনি দাবি করেন, যারা ভারতবিরোধিতা করবে, #Dhurandar তাদের দেখে নেবে এবং ভারত যেভাবে বাংলাদেশ তৈরি করছে, সেভাবে চাইলে ধ্বংস করতেও পারে।
Bhakt Prahlad নামের আরেক ভারতীয় অ্যাকটিভিস্ট ওসমান হাদীকে ভারতবিরোধী দাবি করে লেখেন, “এটা নতুন ভারত—#Dhurandhar তোমার জায়গায় গিয়ে তোমাকে হত্যা করবে।”
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ওসমান হাদিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি সীমান্তে ঝুলিয়ে হত্যার আহ্বান জানানো পোস্টও ছড়ানো হয়েছে।
হামলার আগে থেকেই ওসমান হাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। গত নভেম্বর মাসে তিনি দাবি করেন, বিদেশি নম্বর থেকে একাধিকবার ফোন ও বার্তা পাঠিয়ে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে হামলার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ওপর দায় চাপানোর চেষ্টাও করা হয়েছে। বিভিন্ন পোস্টে রাজনৈতিক নেতাদের নাম উল্লেখ করে অভিযোগ তোলা হয়। একই সঙ্গে এআই দিয়ে তৈরি ভুয়া ছবি ও বিকৃত ভিজ্যুয়াল ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরির অভিযোগ উঠেছে।
দ্য ডিসেন্ট–এর যাচাই অনুযায়ী, এসব ভাইরাল ছবির সঙ্গে বাস্তব ঘটনার কোনো মিল নেই এবং সেগুলোর বেশিরভাগই কৃত্রিমভাবে তৈরি বা বিকৃত।
বিশ্লেষকদের মতে, ওসমান হাদির ওপর হামলার পর একটি সংঘবদ্ধ অনলাইন অপপ্রচার শুরু হয়েছে, যার লক্ষ্য রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি এবং ঘটনার প্রকৃত দিক আড়াল করা।





