এরশাদের একক অভিনয়ে ২১ নভেম্বর মঞ্চে আসছে ‘ভাসানে উজান’
তারুণ্যনির্ভর সক্রিয় নাট্যসংগঠন বিবেকানন্দ থিয়েটার আগামী ২১ নভেম্বর ২০২৫, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে দলের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’ নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়নের করবে। দস্তয়ভস্কির ছোটগল্প “দ্য জেন্টেল স্পিরিট” অবলম্বনে নাট্যকার অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ, শুভাশীষ দত্ত তন্ময় এর নির্দেশনা এবং এরশাদ হাসান এর একক অভিনয়ে নাটকটি নির্মাণ করা হয়েছে।
নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশের একক অভিনয়ের পথিকৃত, বহুমাত্রিক অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার।
উদ্বোধনী প্রদর্শনীর আগে ২০ নভেম্বর ২০২৫ তারিখ বৃহস্পতিবার বিকাল ৫.৩০ টায় একই মিলনায়তনে নাটকটির প্রেস প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।
নাটকটির মাধ্যমে নাট্যশিল্পী এরশাদ হাসান শিল্পমান, সৃজনশীলতা এবং ক্রমবর্ধমান অভিনয় দক্ষতার একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিতে যাচ্ছেন। ‘ভাসানে উজান’ নাটকে একক অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি বহন করছেন দীর্ঘ অভীনয় জীবনের এক বিশেষ তাৎপর্য।
নাটকের কাহিনী সংক্ষেপ
দস্তয়ভস্কির দ্যা জেন্টেল স্প্রিরিট গল্প অবলম্বনে নাটক ‘ভাসানে উজান’। ভাসানে উজান নাটকের কেন্দ্রিয় চরিত্রের আসরাফ বোয়ারি অতীতে নাট্যদল ভাসানে উজান এর দলীয় প্রধান কিন্তু বর্তমানে তিনি চা বাগানের একজন বন্ধকের কারবারি। অসংখ্য কাস্টমারের ভীড়ে একজন বন্ধকের কাস্টমার সাবরিনা। বন্ধকের জিনিস আনা নেওয়ার মাঝে নিজের কণ্ঠকময় জীবন থেকে পরিত্রাণ পাওয়া, নেশাখোর ও নারী লোলুপ জব্বর খন্দকারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া, দরিদ্র রূপ ব্যাধী থেকে একটু সচ্ছল জীবনের আশায় সাবরিনা সুরক্ষা চায় বন্দকের কারবারী আশরাফ বোয়ারীর কাছে। আশরাফ বোয়ারী নানান সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সাবরিনাকে সুরক্ষা দিতে সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে বিয়ে করে সাবরিনাকে এবং সাবরিনা ব্যক্তি জীবনে পায় সুরক্ষা। কিন্তু খরা কেটে বানের ডাক আসলে নদী উপচিয়ে যেমন দুকূল প্লাবিত হয়ে খাল-বিল-হাওড় সব তলিয়ে দেয় তেমনি উত্তলা হয় সাবরিনা। ফলে ভুল বোঝাবুঝি হয় আশরাফ-সাবরিনা দম্পত্তির মাঝে। অতীত ভুলে যাওয়ার মোহ, অহমিকার ক্রোধ আর আত্মগ্লানির অনুশোচনায় এক সময় আত্মহত্যা করে বসে সাবরিনা। ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা মৃত স্ত্রী সাবরিনার পাশে বসে গভীর রাতে বিপন্ন-নি:স্ব-অসহায় স্বামী আশরাফ বোয়ারী আপন মনে কথায় কথায় হিসাব-বেহিসাবীর কথার নকশা বুনন করে চলে। সে শেষ পর্যন্ত উত্তর মেলাতে পারে না যে, একজন মানুষ সত্যিকারে ভালো হয়ে শেষ পর্যন্ত কি ভালো থাকতে পারে! এই অমীমাংসিত উত্তর খোঁজার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় নাটক ভাসানে উজান। হৃদয়ে রক্তক্ষরণের নাটক ভাসানে উজান।
নির্দেশকের কথা
নাট্যকার অপূর্ব কুমার কুন্ডু’র রচনায় বিশ্বজনীনতা ইতিমধ্যে প্রকাশিত। এবারেও রয়েছে এক নতুনত্ব। ভালো মানুষ হয়ে শেষ পর্যন্ত ভালো থাকা যায় কিনা এ প্রশ্ন এক নতুন বাস্তবতা। সেই বাস্তবতাকে মঞ্চমায়ায় ফুটিয়ে তুলতে অপূর্ব দা’র সংলাপের মাধকতা আর কাহিনীর বিচিত্র ভ্রমন আমার নির্দেশনার জন্য এক আনন্দ ভ্রমন।
ভাসানে উজান নাটকের একক চরিত্রাভিনেতা এরশাদ হাসান প্রায় দুই দশকের বেশি সময় নিয়ে মঞ্চে দাপিয়ে অভিনয় করে চলেছেন। কাজের ব্যাপ্তি ও প্রসারের কারনে একটি একক অভিনয়ের নাটক তুলে ধরা ও তুলে রাখা তার জন্য বিশেষ প্রয়োজন। সে প্রয়োজনে আমরা সমবেত ভাবে সাড়া দিয়ে যে এগিয়ে চলেছি সেটি আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধননামা। তবে আশরাফ বোয়ারীর সান্ত্বনাহীনতার বেদনা যেন সে কোন অবস্থায় না ভোলে এটুকু ছিল বন্ধুত্ব পূর্ণ নির্দেশনার মর্মমূলের মূল কথা।
নাটকটির নির্মান নেপথ্যে মঞ্চ ও আলোয় পলাশ হেনড্রী সেন চেষ্টা করেছে দেখার মাঝে অদেখা আবার অদেখার মাঝে দেখাকে দৃশ্যমান করে তুলতে। এক্ষেত্রে বিন্দু পরিমাণ উপকরণে সিন্ধু সম দৃশ্যকল্প ফুটিয়ে তোলায় তার আন্তরিক প্রচেষ্টা। সংগীতে হামিদুর রহমান পাপ্পু সুরের মূর্ছনায় মনের গহীনে আলো ফেলেছে। পোশাকে এনাম তারা সাকি আশরাফ বোয়ারীর এন্টিক এবং আধুনিক সত্বার রসায়ন নয়ানাভিরাম করে ফুটিয়ে তুলেছে। দ্রব্য সামগ্রীতে ফজলে রাব্বি সুকর্ণ চরিত্রের বহুমাত্রিকতাকে প্রকাশের মুখপাত্রের মতো ব্যাবহার করেছে। কোরিওগ্রাফিতে রবিন বসাক থিয়েটার এবং যাত্রার অভিনয় আঙিকের ফিউশানের উপর জোর দিয়েছে। রূপসজ্জায় আমি চেষ্টা করেছি আশরাফ বোয়ারী মানুষটির মনের চেহারাটাকে রং তুলি দিয়ে আঁকতে।
সকল দর্শক-শ্রোতার আন্তরিক সহযোগিতা আর ভালবাসায় ‘ভাসানে উজান’ নাটকটি মনোজগতে দোলা দিক এটুকুই প্রার্থনা।
নাট্যকারের কথা
লিওতলস্তয়, চেখভ থেকে গোর্কী প্রায় সকলেই চেষ্টা করেছেন মানব মনের অর্ন্তজগৎকে সর্ব সম্মুখে তুলে ধরতে তাদের সৃজিত আপন সাহিত্য কর্মে। দস্তায়ভস্কি এক্ষেত্রে আরও তীক্ষ্ণ ও ধারালো। সমষ্টির নিষ্পেষণ, পরিত্যাক্তকে কতটা একাকিত্বে পৌঁছে দেয় যা প্রায় অর্ধমৃতের মতো যন্ত্রণার-কষ্টের এবং সান্ত্বনাহীনতার তা দৃশ্যমান যেমন দস্তয়ভস্কির ছোট গল্পে তেমনই ‘ভাসানে উজান’ নাট্যরূপে।
নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন নাটকের মানুষ, একজন বন্ধকের কারবারি, একজন প্রেমিক মানুষ, একজন ন্যায়বান মানুষ, যার জীবনে নেমে আসে নিয়তির মতো সম্পর্কের নির্মম আঘাত, যার জীবনটাই কন্টাকাকৃত পথে পথ চলার, তেমনই একজন মানুষ আশরাফ বোয়ারী। লেয়ারে লেয়ারে তার যে জীবন বাস্তবতা এবং বহুমাত্রিক জীবন বোধের উপলব্ধি তা দূরহ-কঠিন এবং ভংগুর। ভালো হয়ে ভালো থাকাটা সম্ভব কিনা সে সংশয়ের উত্তর, মীমাংসার হিসাবে সে মেলাতে পারে না।
শুভাশীষ দত্ত তন্ময় তার সূক্ষ্মাতি সূক্ষ দিকনির্দেশনা আর এক দীর্ঘ জীবনের অভিনয় জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে মো: এরশাদ হাসান আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন আশরাফ বোয়ারী চরিত্রটিকে মঞ্চের ক্যানভাসে জীবন্তভাবে পোট্রেট করতে। চরিত্রের আত্ম-জিজ্ঞাসায় আমরাও দর্শক শ্রোতার সাথে এক হয়ে একসাথে মঞ্চ মায়ায় উত্তর খুঁজে চলবো, সত্যিই ভালো হয়ে ভালো থাকা যায় কিনা!





