ঢাকায় সুরময় বিকেল — ধ্রুপদী সঙ্গীত যাত্রায় মুগ্ধ শ্রোতারা
বাংলা ধ্রুপদী সঙ্গীতের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সুরে ভরপুর এক বিকেল উপহার দিলেন অদিত্য নির্মল। রাজধানীর মগবাজারে সিদ্ধেশ্বরী ব্যাচ ’৬৯ আয়োজন করে এক সুরময় বিকেলের, যেখানে রাগ, ঠুমরি, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতির মেলবন্ধনে শ্রোতারা বিমুগ্ধ হয়ে পড়েন।
“সঙ্গীত সেই বিশ্বজনীন সেতুবন্ধন, যা হৃদয়কে যুক্ত করে, শব্দের সীমা ছাড়িয়ে আত্মাকে ছুঁয়ে যায়।” এই ভাবনাকে ধারণ করে বুধবার (২২ অক্টোবর ২০২৫) বিকেলে রাজধানীর মগবাজারের একটি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় এক মনোমুগ্ধকর ধ্রুপদী সঙ্গীতানুষ্ঠান ও আলোচনা সভা। আয়োজন করে সিদ্ধেশ্বরী ব্যাচ ’৬৯। বিকেল ৪টায় শুরু হওয়া এই আয়োজনে অডিটোরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে সঙ্গীতপ্রেমীদের উপস্থিতিতে।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন আদ্দীন মেডিকেল কলেজের উপদেষ্টা ডা. মুনশি আনোয়ার হোসেন এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিদ্ধেশ্বরী ব্যাচ ’৬৯-এর কনভেনার ফজলুল করিম আবিদ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর মোস্তফিজুর রহমান, যিনি প্রতিষ্ঠানের গর্বিত প্রাক্তন ছাত্র ও প্রজন্মের অনুপ্রেরণা।
লখনৌ, ভারতের পণ্ডিত রবিশঙ্কর ঘরানার অধীনে পণ্ডিত সমরেশ চৌধুরীর শিষ্য শ্রী অদিত্য নির্মল ছিলেন এ আয়োজনের মূল শিল্পী ও উপস্থাপক। তিনি ছিলেন প্রধান কণ্ঠশিল্পী, বর্ণনাকার ও গল্পকার, যিনি ধ্রুপদী সঙ্গীত ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্কিত ইতিহাসকে এক মনোমুগ্ধকর সুরযাত্রার মাধ্যমে তুলে ধরেন। বাংলা ভাষা, মানুষ ও সংস্কৃতির বিবর্তনকে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ঐতিহাসিক বিকাশের সঙ্গে যুক্ত করে তিনি ব্যাখ্যা করেন ধ্রুপদ থেকে খেয়াল, ঠুমরি ও ভজন ধারার বিকাশ।
বাঙলায় বর্ণনার পাশাপাশি পরিবেশিত হয় রাগ কৌশিক ধ্বনি, রাগ খামাজ, রাগ ভৈরবী, রাগ যামন ও রাগ বসন্ত। পরিবেশনায় ছিল ছোট খেয়াল ও বাংলা খেয়াল—যেখানে অদিত্য নির্মল বাংলাদেশের পথিকৃৎ ও নবপ্রবর্তক হিসেবে পরিচিত। তিনি রাগ কৌশিক ধ্বনি, ভৈরবী ও বাংলা খেয়াল পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। পরিবেশনার ফাঁকে তুলে ধরেন বাংলা ভাষা ও জাতিসত্তার ইতিহাস এবং এর সঙ্গে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সম্পর্ক। সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতির সংযোগ তিনি ফুটিয়ে তোলেন নজরুলগীতি, হাম্দ-নাত ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে।
সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় নজরুলগীতির মধ্যে “বাগিচায় বুলবুলি তুই” ও “ভরিয়া পুরণ”, যা অদিত্য নির্মল নিজেই হরমোনিয়ামে পরিবেশন করেন। এছাড়া আরও একটি নজরুলগীতি ও একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রোতাদের গভীর আবেগে ভরিয়ে তোলে। ঠুমরি “কাকরু সাজনি” পরিবেশিত হয় অনবদ্য আবেগ ও ধ্রুপদী ঘরানার প্রকাশে।
যন্ত্রসঙ্গীতে অংশ নেন শ্রী দিলীপ বিশ্বাস (হরমোনিয়াম), পণ্ডিত উজ্জ্বল রায় ও রাহুল চ্যাটার্জি (তবলা), যারা তিনতাল লহরায় যুগলবন্দি পরিবেশন করে মন জয় করেন। পণ্ডিত উজ্জ্বল রায় ভারতের খ্যাতনামা তবলাশিল্পী, যিনি পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী, পণ্ডিত অশোক মেহতা, পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকর, পণ্ডিত যোগেশ সামসি ও পণ্ডিত স্বরাজ ভট্টাচার্যের শিষ্য। রাহুল চ্যাটার্জি তাঁর শিষ্য এবং দিলীপ বিশ্বাস প্রশিক্ষণ নিয়েছেন পণ্ডিত জ্যোতি গোহো-র কাছ থেকে।
ধ্রুপদী ও যন্ত্রসঙ্গীতের পাশাপাশি অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, ঠুমরি ও কবির সুমনের বাংলা খেয়াল রচনা। এছাড়া জীবনানন্দ দাশ, কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দিনের কবিতা ও দর্শনভিত্তিক ভাবনাও অন্তর্ভুক্ত হয়, যা হাম্দ পরিবেশনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনুষ্ঠানে আধ্যাত্মিক ও সাহিত্যিক মাত্রা যোগ করে।
পুরো বিকেলজুড়ে শ্রোতারা ছিলেন বিমুগ্ধ। প্রতিটি আলাপ, তান ও তালের ছন্দে করতালির ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় অডিটোরিয়ামে। শিল্পীদের নিষ্ঠা ও সুরের গভীরতা প্রমাণ করে দেয়—সঙ্গীতই সেই ভাষা, যা শব্দের সীমা ছাড়িয়ে হৃদয়কে এক করে দেয়। অনুষ্ঠানটি চমৎকারভাবে সমন্বয় ও আয়োজন করে সিদ্ধেশ্বরী (৬৯ ব্যাচ), যাদের প্রচেষ্টা ধ্রুপদী ঐতিহ্য সংরক্ষণে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।





