শরণার্থীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে জার্মান সরকার

জার্মানিতে ২০২৪ সালে স্বীকৃত আশ্রয়প্রার্থী ও সুরক্ষার নিশ্চিত অধিকার পাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৩ লাখ। এর মধ্য দিয়ে জার্মানির জনসংখ্যা বেড়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। রক্ষণশীলদের নেতৃত্বে থাকা দেশটির নতুন সরকার এই সংখ্যাটি কমাতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে।
জার্মানির সেন্ট্রাল রেজিস্টার অফ ফরেইন ন্যাশনালস জানিয়েছে, ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সুরক্ষা মর্যাদা পাওয়া মানুষের সংখ্যা তার আগের বছরের তুলনায় অন্তত ১ লাখ ৩২ হাজার বেড়েছে। এই পরিসংখ্যানে আশ্রয়প্রার্থী এবং অস্থায়ী সুরক্ষা মর্যাদা পাওয়া মানুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জার্মানির ফেডারেল পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য বলছে, ৩৩ লাখ স্বীকৃত শরণার্থীর মধ্যে ইউক্রেন থেকে আসা ১০ লাখেরও বেশি যুদ্ধ শরণার্থী রয়েছেন। সিরীয়দের সংখ্যা ৭ লাখ ১৩ হাজার। আফগানিস্তানের নাগরিকদের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৮ হাজার। ইরাকি আছেন ১ লাখ ৯০ হাজার। তুরস্কের নাগরিকের সংখ্যা ১ লাখ ৫৭ হাজার। আর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৭৭ হাজার। তাদের মধ্যে অন্তত অর্ধেক এসেছেন সোমালিয়া, ইথিওপিয়া এবং ইরিত্রিয়াসহ হর্ন অফ আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলো থেকে।
পরিসংখ্যান বলছে, ৮ কোটি ৩৩ লাখ মানুষের দেশ জার্মানির প্রতি ২৫ জনে একজন আশ্রয়প্রার্থী। তবে, জার্মানির বিভিন্ন রাজ্য বা অঞ্চল ভেদে এই সংখ্যার তারতম্য হতে পারে।
শরণার্থীদের মধ্যে তারুণ্যের আধিক্য
পরিসংখ্যান বলছে, জার্মানিতে অবস্থানরত শরণার্থীরা জার্মানদের তুলনায় তরুণ। কারণ, ২০২৪ সালে শরণার্থীদের গড় বয়স ছিল ৩২ বছর। জার্মানির মোট জনসংখ্যার গড় বয়স ৪৫ বছর ছয় মাস।
জার্মানিতে ইউক্রেনীয়দের গড় বয়স ৩৫ বছর। সিরীয় এবং আফগান শরণার্থীদের গড় বয়স যথাক্রমে ২৮ এবং ২৭ বছরের একটু কম।
স্বীকৃত শরণার্থীদের অন্তত ৪৫ শতাংশ নারী। ইউক্রেনীয়দের মধ্যে নারীর সংখ্যা অন্তত ৬০ শতাংশ। কারণ, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণে বেশিরভাগ ইউক্রেনীয় পুরুষ দেশ ছাড়েননি বা ছাড়তে দেওয়া হয়নি।
পরিসংখ্যান আরও বলছে, জার্মানিতে স্বীকৃত শরণার্থীদের চার ভাগের এক ভাগ ১৮ বছরেরও কম বয়সী শিশু এবং কিশোর-কিশোরী।
ইউরোপে সর্বোচ্চ সংখ্যক শরণার্থী জার্মানিতে
৩৩ লাখ শরণার্থীর মধ্যে ৮২ শতাংশের বা ২৭ লাখের বেশি মানুষের জার্মানিতে বসবাসের অনুমতি রয়েছে। আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছেন ৪ লাখ ২৭ হাজার জন।
১ লাখ ৭১ হাজার আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তাদের দেশ ছেড়ে যেতে বলা হলেও তারা এখনো জার্মানিতেই রয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে জোরপূর্বক নির্বাসন বা স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন সম্পন্ন করতে এক মাস থেকে বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
আরও ১ লাখ ৩৬ হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে তথাকথিত সহনশীলতা বা ডুলডুং-এর আওতায় জার্মানিতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মূলত এসব আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয় আবেদন মঞ্জুর হয়নি। কিন্তু শারীরিক অবস্থাসহ বিশেষ বিবেচনায় তাদের প্রত্যাবাসন না করে জার্মানিতে অস্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
আশ্রয়নীতিতে বড় পরিবর্তনের পরিকল্পনা
রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল সিডিইউ/সিএসইউ নেতা ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস মাস দুয়েক আগে জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছেন। ক্ষমতাগ্রহণের পরপরই পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আশ্রয় ইস্যুতে কঠোর হয়েছেন তিনি। শরণার্থীর সংখ্যা কমানোর ক্ষেত্রে বেশ মনোযোগী তার সরকার।
জার্মানিতে সুরক্ষা চাওয়া বেশিরভাগ মানুষ মূলত স্থল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশটিতে আসেন। জার্মানির সঙ্গে সেসব দেশেরই সীমান্ত রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সুইজারল্যান্ড ছাড়া অন্য দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য।
ম্যার্ৎসের যুক্তি হলো, আশ্রয়প্রার্থীদের জার্মানিতে পৌঁছানোর আগে অন্য ইইউ দেশে (এবং সুইজারল্যান্ডে) তাদের আশ্রয় আবেদন করা উচিত। ডাবলিন রেগুলেশন অনুযায়ী, আশ্রয়প্রার্থীরা প্রথম যে ইইউ দেশে পৌঁছান সেখানে তাদের আবেদন জমা দিতে হয়।
কিন্তু অনেক আশ্রয়প্রার্থী সেটা করেন না। বিশেষত পরিবারের সঙ্গে যোগ দিতে কিংবা যে অঞ্চলটিতে নিজের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব আছে, আশ্রয়প্রার্থীরা সেখানেই পৌঁছাতে চান।
কিন্তু বর্তমান জার্মান সরকার সেই সুযোগটিকেও সীমিত করে আনছে। কারণ, প্রতিবেশী নয়টি দেশের সঙ্গে থাকা সীমান্তে কড়া পাহারার পাশাপাশি সীমান্ত থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে দেশটি। প্রতিবেশী দেশগুলো এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও নিজেদের অবস্থানে অনড় জার্মান সরকার।
স্থগিত পারিবারিক পুনর্মিলন
অস্থায়ী সুরক্ষা মর্যাদা পাওয়া শরণার্থীদের পারিবারিক পুনর্মিলনের অধিকার স্থগিত করেছে জার্মানি। এ সংক্রান্ত সরকারের একটি পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছে জার্মান পার্লামেন্ট বুন্ডেসটাগ। এই বিতর্কিত ও সমালোচিত সিদ্ধান্তের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে সিরীয় পরিবারগুলো।
মানবাধিকার সংস্থা প্রো অ্যাসিল বলেছে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে বড় ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। এতে সমাজে অন্তর্ভুক্তির পথ কঠিন হওয়ার পাশাপাশি অনিয়মিত অভিবাসনের ঝুঁকিও বাড়ছে। সন্তান, বাবা-মা বা স্বামী/স্ত্রীর সঙ্গে পুনর্মিলনের কোনো আইনি পথ না থাকলে কিছু মানুষ জার্মানিতে থাকা প্রিয়জনের কাছে পৌঁছাতে অনিয়মিত এবং অনিরাপদ পথ বেছে নেওয়ার ঝুঁকি নেবেন বলে শঙ্কা করছে এনজিওটি।
আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা কমানোর উদ্যোগ
চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগেই ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস বলেছিলেন, প্রতি বছর জার্মানিতে আশ্রয় চাইতে আসা মানুষের সংখ্যা এক লাখের নিচে রাখতে চান তিনি।
বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার ডোব্রিন্ট অবশ্য বলেছেন, বার্ষিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা দুই লাখের নিচে নামিয়ে আনতে চান তিনি।
জার্মানির সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ফোকাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অবশ্যই একটি দেশের শরণার্থীদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার একটি সীমা থাকে। আর তাই অতীতের ঊর্ধ্বসীমা নিয়ে কথা বলা সঠিক ছিল।
তিনি বলেন, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে ছয় লাখেরও বেশি আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয় আবেদন নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ১০ লাখের বেশি ইউক্রেনীয় ইইউ আইনের অধীনে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন।
ডোব্রিন্ট বলেছেন, এমন বাস্তবতায় আমরা তাত্ত্বিকভাবে দুই লাখের নিচে রাখার কথা বললেও আজকের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংখ্যাটিও অনেক বড়।
তিনি আরও বলেন, আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি নিয়মিত অভিবাসনের পথ শক্তিশালী করা প্রয়োজন। কারণ, জার্মানির শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি প্রতিনিয়ত তীব্র হচ্ছে।