লাভলীর যন্ত্রণার অবসান

নিউ ইয়র্কের আকাশটা তখনো জেগে ছিল। শহরের আলো নিভে না গেলেও মানুষের চোখে ঘুম নেমেছিল নিঃশব্দে। কুইন্সের জ্যামাইকার একটি পুরনো অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে সেই ঘুমের মধ্যে হঠাৎই ছিন্ন হয়ে যায় নিস্তব্ধতা। ২০২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, শনিবার—ভোর রাতের এক রহস্যময় মুহূর্তে, যখন শিশুরা স্বপ্ন দেখে তখন এক ছুরি বিদীর্ণ করছিল স্ত্রীর বুক—চুপচাপ, শব্দহীন, যেন বিষাদের প্রতীক হয়ে ওঠা রাতটিরই ভাষ্য।
শাহিদা সুলতানা লাভলী—রাজশাহীর শান্ত পাড়ার এক মেয়ে। একদিন বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন আমেরিকায়, ভালোবাসার হাত ধরে। স্বামী মোহাম্মদ সুলাইমান, চট্টগ্রামের ছেলে, ছিলেন স্বপ্নের নায়ক। ২০০২ সালে বিয়ে, তারপর জীবনের চাকা ঘুরেছে নিউ ইয়র্কে এসে। কিন্তু বিদেশের মাটিতে গড়া সংসারটা ছিল না কোনও রূপকথার গল্পের মতো। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, দাম্পত্য কলহ আর অসম প্রতিযোগিতার এক বিষাক্ত বাতাসে প্রতিদিন বিষিয়ে উঠছিল লাভলীর নিঃশ্বাস।
প্রায়ই সুলাইমান লাভলীর গায়ে হাত তুলতেন। লাভলীর বোন ফেরদৌসী জানান, সুলাইমান তাঁকে বাংলাদেশি কমিউনিটি ইভেন্টে যেতে নিষেধ করতেন, যাতে কেউ তাঁর নির্যাতনের কথা জানতে না পারে।যেহেতু লাভলীর গ্রিন কার্ড ছিল না, তাই তিনি অভিযোগ করতে ভয় পেতেন। সুলাইমান লাভলীর গ্রিন কার্ড প্রক্রিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করছিলেন, যাতে সে তাঁর উপর নির্ভরশীল থাকে। লাভলী একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন, কিন্তু সুলাইমান তাঁর সমস্ত ইনকাম নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়ে যেতেন। লাভলীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র $২০ ডলার রাখা হতো।
তানজিয়া জেনিফার, মাত্র চার বছর বয়স। সেই রাতে সে মা’র পাশে ঘুমাচ্ছিল। কি দেখেছিল সে? কিছু কি শুনেছিল? নাকি পুরোটা নিঃশব্দে ঘটে গিয়েছিল তার সামনে—জীবনের প্রথম ট্র্যাজেডি, যা সে হয়তো কোনোদিনও পুরোপুরি মনে করতে পারবে না, আবার ভুলেও যেতে পারবে না।
সকাল হতেই ভবনের করিডোরে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্কের খবর। কেউ একজন ফোন করে জানায় ফেরদৌসী বেগমকে—লাভলীর বড় বোন, যিনি থাকতেন এই একই বিল্ডিংয়ের অন্য একটি ফ্ল্যাটে। তিনি দৌঁড়ে আসেন, দরজার সামনে পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, আর সেই নিস্তব্ধতা—যেটা সবচেয়ে বেশি ভয়ানক। লাভলীর নিথর দেহ পড়ে আছে বিছানায়, মুখে এক ধরণের প্রশান্তি, যেন বহুদিনের যন্ত্রণার অবসান।
পুলিশ জানায়, ঘুমন্ত অবস্থায় ছুরিকাঘাতে লাভলীকে হত্যা করেছেন তার স্বামী সুলাইমান। ঘটনার পরেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে, হত্যার অস্ত্র জব্দ করে তৎক্ষণাৎ তাঁকে হাজির করা হয়েছে কুইন্স ক্রিমিনাল কোর্টে। মেডিকেল এক্সামিনারের রিপোর্ট নিশ্চিত করে—এটা হত্যা। আদালতে সুলাইমান স্বীকারোক্তি দেন।
২০২২ সালের মার্চ মাসে নিউ ইয়র্ক কোর্ট সুলাইমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। বর্তমানে তিনি নিউ ইয়র্কের রাইকার্স দ্বীপের কারাগারে আটক রয়েছেন।
এ ঘটনায় নিউ ইয়র্কে বসবাসরত প্রবাসী নারীদের মধ্যে একধরনের উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই বলেন, লাভলীর মতো তাঁরাও এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু বলার জায়গা নেই।
তানজিয়াকে প্রথমে নিউ ইয়র্কের চাইল্ড প্রটেকটিভ সার্ভিসেস (CPS)-এর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। পরে লাভলীর বড় বোন ফেরদৌসী বেগম (যিনি একই বিল্ডিংয়ে থাকতেন) আদালতের মাধ্যমে তানজিয়ার অভিভাবকত্ব লাভ করেন। সুলাইমানের পরিবার (চট্টগ্রামে অবস্থিত) তানজিয়াকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিলে ফেরদৌসী ফ্যামিলি কোর্টে মামলা করেন। ২০২৩ সালের রায়ে তানজিয়াকে ফেরদৌসীর কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
লাভলীর দেহ বাংলাদেশে পাঠানো হয় এবং রাজশাহীর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। লাভলীর বড় বোন ফেরদৌসী বলেন, লাভলী মেয়েকে নিয়ে স্বাবলম্বী হতে চেয়েছিল। সে ১০ বছর ধরে নির্যাতন সহ্য করে। গ্রিনকার্ড নেই দেখে সে কোনো পদক্ষেপ নিতে সাহস পেতো না। বারবার বলত, ‘আমি মেয়েকে নিয়ে পালাতে চাই, কিন্তু আমারতো PAPERS নেই।’
একজন প্রবাসী নারীর নিঃশব্দ যন্ত্রণার গল্প শেষ হয় খুনের এক তীক্ষ্ণ ছুরিতে। আর প্রশ্ন রেখে যায়—কত লাভলী এভাবে নিঃশব্দে ঝরে পড়ছেন, যাদের গল্প আর বলা হয় না।