ম্যানিটোবার তুষারে হারিয়ে যাওয়া তিনটি নাম
কানাডার প্রান্তরে তখন শীতের চূড়ান্ত রূপ। উইনিপেগ শহরের উত্তর প্রান্ত, হাইওয়ে ৭-এর উপর জমে থাকা বরফের স্তর যেন রুপালি বিষাদের চাদর। চারদিকে নীরবতা, ঘন কুয়াশা, আর ক্রমশ জমে ওঠা তুষারের নিচে একেকটি দিন ডুবে যায় নিঃশব্দে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, এমনই এক তীব্র ঠান্ডার ভোরে তুষারে হারিয়ে গেলো তিনটি নাম।
তারা ছিলেন ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই শহরই ছিল তাদের স্বপ্নের নোঙর—যেখানে তারা পড়াশোনা করত, কাজ করত, হাসত, কান্না করত, আর একসাথে গড়ে তুলছিল ভবিষ্যতের রূপরেখা। প্রবাসী জীবনের নিয়ম-কানুনে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল, বুঝে উঠছিল কানাডার ঠান্ডা আবহে কীভাবে বাঁচতে হয়, বরফের ভিতরে কীভাবে উষ্ণতা খুঁজে নিতে হয়।
উইনিপেগ—প্রায় সারাবছর তুষারে ঢাকা এই শহর যেন বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এক নতুন মানসিক ভূগোল। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে আসা বাংলাদেশি তরুণরা একধরনের অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা—যেখানে সব কিছুর কেন্দ্রে থাকে স্বপ্ন, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, আর বাংলাদেশের সাথে এক অদৃশ্য সংযোগ।
আরানূর আজাদ মোহাম্মদপুরের সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার (SFX) গ্রিনহেরাল্ড স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই চোখে ছিল অদ্ভুত এক দীপ্তি, যেন অঙ্ক আর ডেটার মধ্যেই তিনি দেখতেন পৃথিবীর গতি। ২০১৭ সালে কানাডা আসেন, ভর্তি হন ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে। তাঁর লক্ষ্য ছিল ডেটা সায়েন্টিস্ট হওয়া, আর নিজের একটি আইটি কোম্পানি গড়া।
আল নুমান আদিত্য, নাটোরের ছেলে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ফুড সিকিউরিটি—এসব ছিল তার চিন্তার জগৎ। কৃষি অর্থনীতি নিয়ে পড়ছিলেন, আর মাঝে মাঝে রান্না করে বন্ধুদের খাওয়াতেন। তার স্বপ্ন ছিল নাটোরে অর্গানিক ফার্ম তৈরি করা, যেখানে কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে।
রাইসুল বাধন, ঢাকার মোহাম্মদপুরের ছেলে। অঙ্ক ও হিসাবের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ টান। ২০১৭ সালে আসেন কানাডায়। অ্যাসপার স্কুল অফ বিজনেসে পড়তেন একাউন্টিং ও সাপ্লাই চেইনে। তাঁর লক্ষ্য ছিল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (CA) হয়ে চট্টগ্রামে একটি একাউন্টিং ফার্ম খোলা।
তারা তিনজন ছিলেন একে অপরের ছায়াসঙ্গী। উইনিপেগের বাঙালি কমিউনিটিতে তারা ছিলেন পরিচিত মুখ। শুক্রবারের নামাজে, ঈদের জামাতে, বাংলা নববর্ষের মিলনমেলায়, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তারা যেন ছিলেন প্রবাসী তরুণ সমাজের প্রতিনিধি।
ফেব্রুয়ারির সেই কনকনে শীতে, ১৭ ফেব্রুয়ারির রাত প্রায় ৩টার দিকে, তারা রওনা দিয়েছিলেন উত্তরের পথে—একটি স্বপ্ন দেখতে। নর্দার্ন লাইটস, আর্কটিক আকাশে নাচতে থাকা সবুজ-নীল-জ্যোতির্ময় আলোর নৃত্য—যা সাধারণত দেখা যায় অতি ঠান্ডা অঞ্চলে। তিন বন্ধু মিলে সেই রূপকথার দৃশ্য দেখার সিদ্ধান্ত নেন।
তারা চারটি গাড়িতে বিভক্ত ছিলেন। একটি গাড়িতে ছিলেন আরানূর, আদিত্য ও বাধন। অন্য গাড়িগুলো একটু পেছনে ছিল, কেউ কেউ থেমেছিলেন জ্বালানি নিতে, কেউ খাবার কেনার জন্য।
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা ৩০ মিনিটের দিকে, যখন ঘন কুয়াশা পথ ঢেকে রেখেছে, যখন ঠান্ডা বাতাসে জমে ওঠা বরফ সড়কে এক অদৃশ্য ফাঁদ তৈরি করেছে—ঠিক তখনই ঘটে সেই মর্মান্তিক ঘটনা। হাইওয়ে ৭-এর উপর একটি হেড-অন সংঘর্ষ, যেখানে একটি সেডান আর একটি এসইউভি মুখোমুখি আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। একপাশে পড়ে থাকে উল্টে যাওয়া গাড়ি, ভাঙা জানালা, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ব্যাগ, কাগজ, আর গলে যেতে থাকা রক্ত-তুষারের মিশ্রিত স্তর।
ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু ঘটে। আরেকটি গাড়িতে থাকা ৫৩ বছর বয়সী নারী আহত অবস্থায় নেওয়া হয় উইনিপেগের হাসপাতালে।
পেছনের গাড়িতে থাকা তাদের বন্ধু ফারদিন জারিফ যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছান, তখন তিনি বলেন, “আমরা শুধু দেখলাম—তাদের গাড়ি উল্টে আছে। চারদিক নিস্তব্ধ, যেন সময় থমকে গেছে।”
১৮ ফেব্রুয়ারির মধ্য দুপুরে, তাদের মৃত্যুর খবর পৌঁছায় বাংলাদেশে—মোহাম্মদপুরে, নাটোরে আর আগ্রাবাদে। সেই রাতেই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নেমে আসে এক রক্তাক্ত স্তব্ধতা।
পরদিন, ১৯ ফেব্রুয়ারি, উইনিপেগের আল-জামে মসজিদে তাদের জানাজা সম্পন্ন হয়। তাদের সহপাঠী, শিক্ষকমণ্ডলী, প্রবাসী বাংলাদেশিরা দাঁড়িয়েছিলেন নীরব শ্রদ্ধায়। যে তিনজন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হেঁটেছিলেন এই প্রবাসের পথে, সেই তিনজন এবার শুয়ে ছিল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে গেলেন চিরনিদ্রায়। দুর্ঘটনার প্রায় তিন সপ্তাহ পর ওদের মরদেহ বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের স্মরণে একটি ভার্চুয়াল মেমোরিয়াল প্রোগ্রাম আয়োজন করে। একাধিক অধ্যাপক ও শিক্ষার্থী তাদের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “তারা শুধু মেধাবী ছিলেন না, তারা ছিলেন নেতৃত্বের প্রতীক।”
আদিত্য দুর্ঘটনার আগের দিন তার ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন নর্দার্ন লাইটসের ছবি। ক্যাপশনে লিখেছিলেন: “Lights from heaven.” কে জানত, সেটাই হবে তার শেষ আলোকদ্যুতি!





