বাবারা কখনো ‘ছুটি’ নেন না!
বছরের পর বছর কেটে যায়। ঈদ আসে, উৎসব আসে, অফিসে ছুটি হয়। স্কুলে ‘উইন্টার ভ্যাকেশন’, ‘সামার হলিডে’ ঘোষণা হয়। উৎসব-আনন্দে মেতে উঠে সবাই। কিন্তু একজন মানুষের যেন কোনো ছুটি নেই। বছরের ৩৬৫ দিনের ২৪ ঘণ্টাই যেন বাবাদের ডিউটি থাকে।
একজন বাবা ছুটি নিতে পারেন না-মানসিকভাবে না, শারীরিকভাবে না। সন্তান স্কুলে না গেলে ক্লাস মিস হয়, কিন্তু বাবা কাজে না গেলে হয় সংসারের চাকা থেমে যাওয়া। অফিস বন্ধ থাকলেও তিনি খোঁজ রাখেন কৃষি কাজের, ব্যবসা কিবা দোকানের, টাকার। রিকশাচালক হোন বা শিক্ষক, দিনমজুর হোন বা করপোরেট কর্মকর্তা—বাবা মানেই নিরলস ছায়াদানকারী এক বটবৃক্ষ। যিনি ক্লান্ত হলেও হাসেন, অসুস্থ হলেও অফিসে যান, খালি হাতে ঘরে ফিরলেও সন্তানের মুখে হাসি ফেরাতে পারেন। যিনি-কখনোই ছুটি নেন না।
একজন বাবার দায়িত্ব শুরু হয় সন্তানের জন্মের দিন থেকেই। বাবা হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে নীরবে অশ্রু বিষর্জন দেন। ভাবেন-এই মুহূর্তে আমি ‘বাবা’। মা তখন বিশ্রামে, আত্মীয়রা ব্যস্ত দেখভালে, কিন্তু হাসপাতালের খরচ, ওষুধ, রক্ত, রিপোর্ট-সবটা ঘুরে বাবার মাথার মধ্যে।
ছুটি মানেই তাদের আরও ব্যস্ততা
পৃথিবীর সব বাবাই জানেন, অফিসের ছুটি মানেই সংসারের বাড়তি কাজের দিন। ঘর মেরামত, বাজার করা, সন্তানদের স্কুলের বই দেখে দেওয়া, বিদ্যুতের বিল দেওয়া, মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া-এসব কাজের জন্যই যেন তার ছুটি বরাদ্দ। আর নিজের জন্য? নেই কোনো সময়। নেই কোনো অভিযোগ, প্রশ্ন।
বাবার অভিধানে ক্লান্তি বলতে কিছু নেই
বাবারা ক্লান্ত হন না—এমন নয়। তাঁরা ক্লান্ত হন, নিঃশেষ হন, হয়তো মাঝেমধ্যে একা ঘরে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিন্তু তাদের মুখে সেই ক্লান্তির প্রকাশ থাকে না, শরীর হোক অসুস্থ, মনের ভেতর থাকুক শত দুশ্চিন্তা—তারা নিজের মধ্যে আবদ্ধ রেখে দেন সব। পরিবারের সামনে তারা যেন একটা ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ মেশিন’, যে কখনও বন্ধ হয় না, বিকল হয় না, শুধু সামনে এগিয়ে চলে। ক্লান্তির কথা বললে সংসারের মন ভারী হবে-এই ভাবনা থেকেই বাবারা ছুটি চান না। বরং তাদের ছুটি নেওয়া মানেই পরিবারের একপ্রকার অস্থিরতা।
বাবারা ডাক্তারের কথা শোনেন না
অনেক সময় বাবারা জ্বর বা মাথাব্যথা নিয়ে অফিস যান। এমনকি ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেন, তবু তারা বলেন, ‘বাড়িতে তো অনেক কিছু বাকি আছে।’ কাজের ফাঁকে ওষুধ খান, ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফেরেন, আবারও রান্নাঘরের গ্যাস লাইন চেক করেন, কিংবা পানির মোটর বিদ্যুতের লাইন ঠিক করেন।
বাবারা নিজেরা ‘অভিনেতা’, অভিনয়টা হয় সবসময়
একজন বাবা তার সন্তানদের সামনে কখনো কাঁদেন না, মুখ ভার করেন না, নিজের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার বেদনা প্রকাশ করেন না। তিনি একটা মুখোশ পরেন—ভরসার, সাহসের, নিশ্চিন্ততার। এই অভিনয় তাঁর পেশা নয়, দায়িত্ব। যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই তিনি হারিয়ে ফেলেন নিজের প্রয়োজন, ইচ্ছা, স্বপ্ন—আর ‘ছুটি’ নামক মানবিক প্রয়োজনটিও। তারা অভিনয় করেন তারা ক্লান্ত নন, তাদের কোনো চাপ নেই। এই প্রতিদিনের অভিনয়ই বাবাদের সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ। এই অভিনয়ে ‘বিরতি’ বা ‘ছুটি’ নেই।
প্রতিদিনের নীরব বিনিয়োগ
একজন বাবা দিনের পর দিন সন্তানের জন্য বিনিয়োগ করেন—টাকা দিয়ে, সময় দিয়ে, নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে। এই বিনিয়োগের রিটার্ন তিনি কখনো চান না, দাবি করেন না। তিনি সন্তানের সামনে শক্ত থাকেন, পেছনে কাঁদেন। সকাল বেলা সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে যিনি নিজের দুঃখ ঢেকে রাখেন, তিনি অভাবী হতে পারেন না। কারণ তার ভেতরের শক্তি, ভালোবাসা ও সহনশীলতা—এসবই একেকটি অমূল্য সম্পদ। এই ধরণের ভালোবাসা মুদ্রায় মাপা যায় না, ব্যালেন্স শিটে ফেলা যায় না। এটা এক ধরনের অনুভবযোগ্য পুঁজি, যেটি একজন বাবা হৃদয়ে ধারণ করেন। বাবা মানেই এমন এক অদৃশ্য দেয়াল, যার ওপর দাঁড়িয়ে সন্তান আকাশ ছুঁতে পারে। তিনি নিজে ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন, কিন্তু সন্তানের গায়ে যেন রোদ না লাগে সেই চেষ্টা করেন সারাক্ষণ। তিনি নায়ক নন, কিন্তু নায়ক তৈরি করেন। তিনি শিক্ষিত হোন বা না হোন, তিনি জানেন কীভাবে সন্তানকে জোরে হাঁটতে শেখাতে হয়।
নিজের প্রয়োজন সবসময় বিসর্জন
বাবাদের একটা অদ্ভুত দক্ষতা থাকে- নিজেকে অদৃশ্য করে রাখার। তিনি চুপচাপ থাকেন যেন সংসারে তার কোনো চাওয়া নেই। কিন্তু প্রতিদিন তাঁর ভেতরে চলে এক যুদ্ধে-নিজের প্রয়োজন বনাম সন্তানের স্বপ্ন। আর সেই যুদ্ধে তিনি স্বেচ্ছায় হার মানেন। তিনি পোশাক পাল্টান না বছর ধরে, ফোনের পুরোনো সেটটা নিয়েই চালিয়ে যান, বন্ধুর বিয়েতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ এড়িয়ে যান-শুধু যাতে ছেলের কোচিং বাকি না পড়ে। এই আত্মত্যাগ, এই নীরব অগ্রাধিকার কোনো মানুষ দিতে পারে না। এ এক ধরণের সমৃদ্ধি, যা অর্থের মানদণ্ড ছাড়িয়ে যায় বহু দূর।
ধৈর্যের যে মাপ নেই
একজন বাবা যেমন দায়িত্বশীল, তেমনই ধৈর্যশীল। সংসারে সমস্যা এলেও তিনি ভেঙে পড়েন না। সন্তানের ভুল-ত্রুটি সহ্য করেন, না বুঝে বলা কথাও মাফ করে দেন। কখনো কোনো কিছুর জবাব দেন না, শুধু ঠান্ডা মাথায় পরদিনের জন্য প্রস্তুতি নেন।
জীবনভর দায় নেন, দাবি করেন না
একজন বাবা তার জীবনে প্রতিটি পদক্ষেপে সন্তানের জন্য দায় নেন। স্কুলে ভর্তি, ইউনিফর্ম, ফি, প্রাইভেট, উচ্চশিক্ষা, চাকরি, বিয়ে-সবকিছুর ব্যবস্থা তিনিই করেন। কিন্তু একবারও বলেন না- ‘এই টাকাটা আমি দিয়েছি’, কিংবা- ‘তুই আমার জন্য কী করলি?’ তিনি জীবনভর দায়িত্ব পালন করেন, বিনিময়ে শুধু সন্তানের প্রাপ্তি দেখতে চান। এরকম নিঃস্বার্থ বিনিয়োগ, বিনিময়হীন ভালোবাসা কোথায় মেলে?





