নিউ ইয়র্ক সিটি নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশদ্ভুত শাহানা হানিফের জয়জয়কার
আজ, মঙ্গলবার রাত। ব্রুকলিনের পার্ক স্লোপের ‘দ্য কমিশনার’ রেস্টুরেন্টে উচ্ছ্বাসের ঢেউ। এক তরুণী, চোখে বিজয়ের দীপ্তি, চারপাশে স্বেচ্ছাসেবকদের আলিঙ্গন আর করতালির গর্জন। এ দৃশ্য শুধু একটি নির্বাচনী বিজয়ের নয়—এ এক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক শাহানা হানিফ আবারও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের ৩৯তম ডিস্ট্রিক্টের প্রতিনিধি হিসেবে।
প্রায় ৭০% ভোট পেয়ে তিনি পরাজিত করেছেন তার ইহুদি প্রতিদ্বন্দ্বী, মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাট মায়া কর্নবার্গকে। এক উত্তপ্ত ও বৈশ্বিক বিতর্ক-প্রবাহিত নির্বাচনী লড়াই শেষে এই জয় শুধু ব্যক্তিগত নয়, তা প্রগতিশীল রাজনীতির, অভিবাসী স্বপ্নের, আর এক নারীর লড়াকু জীবনের পূর্ণতা।
২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনের পর দেশজুড়ে অভিবাসী, মুসলিম ও নারীদের বিরুদ্ধে একটি অব্যক্ত সংশয় ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময়ে যদি কেউ বলত, মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশি নারী নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিলে বসবেন, অনেকেই অবিশ্বাস করত। কিন্তু শাহানা হানিফ সে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন ২০২১ সালের নভেম্বরে। আর আজ, ২৪ জুন ২০২৫—তিনি তা আবারও প্রমাণ করলেন।
শাহানার বাবা-মা ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। তাদের দেশের বাড়ি চট্টগ্রামে। প্রথমে তারা কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসে থাকতেন, পরে কেনসিংটনে চলে যান।
তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, সমাজবিজ্ঞান ও নারী অধিকারে। সেখানে তাঁর রাজনৈতিক চেতনার বীজ রোপিত হয়। মুসলিম নারী, অভিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারে কাজ করতে করতেই তিনি যুক্ত হন “Arab American Association of New York” ও “Democratic Socialists of America (DSA)” এর মতো সংগঠনের সঙ্গে।
২০২১ সালে, মাত্র ২৯ বছর বয়সে, তিনি প্রথম বাংলাদেশি-মার্কিন, প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে নিউ ইয়র্ক সিটির কাউন্সিলে নির্বাচিত হন।
শাহানা হানিফের রাজনৈতিক পথচলা সবসময়ই বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে তার ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে অবস্থান। তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘অপারেশনাল অ্যাপারথাইড’ ভাষা ব্যবহার করেন, ইনতিফাদার সমর্থনে টুইট করেন, এমনকি ২০২৩ সালে নিউ ইয়র্ক সিটির একটি ইহুদি-বিরোধিতাবিরোধী প্রস্তাবে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানান।
তার এই অবস্থান মুসলিম ও প্রগতিশীল মহলে প্রশংসিত হলেও, ইহুদি নেতাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই বছর, প্রতিদ্বন্দ্বী কর্নবার্গ বারবার এই বিষয়টি সামনে আনেন এবং বলেন, “শাহানা হানিফ স্থানীয় সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বেশি জোর দিচ্ছেন।”
হানিফের পুনঃনির্বাচন শুধু তার অবস্থানকে বৈধতা দিল না, বরং নিউ ইয়র্ক সিটির অভিবাসী, শ্রমিক, নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে এক নতুন আশার প্রতীক হয়ে উঠল। তাঁর প্রচারণা চলেছে নীতির ওপর, আবেগের ওপর নয়। তিনি তুলে ধরেন সাশ্রয়ী আবাসনের জন্য তাঁর লড়াই, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর সফলতা, এবং শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে পাসকৃত ১৪টি বিল।
এবারের নির্বাচনে তাঁর পাশে ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ, ইয়েভেট ক্লার্ক, ব্র্যাড ল্যান্ডারসহ প্রভাবশালী প্রগতিশীল রাজনীতিকরা এবং নিউ ইয়র্ক স্টেট নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন ও সেন্ট্রাল লেবার কাউন্সিলের মতো শ্রমিক সংগঠন।
কর্নবার্গ, যিনি এনওয়াইইউ’র ব্রেনান সেন্টারের গবেষণা ফেলো, শেষ দিকে কিছু পুরোনো ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন পেলেও তা ভোটে রূপান্তর করতে পারেননি। তিনি ভোট পেয়েছেন মাত্র ২৬%। ফলাফল ঘোষণার পরে তিনি এক্স (টুইটার)-এ লেখেন, “যদিও আমরা জিতিনি, আমরা একটি ইস্যু-ভিত্তিক ইতিবাচক প্রচারণা করেছি—এটাই গর্বের।”
হানিফ আজ রাতে তাঁর বিজয় ভাষণে বলেন, “মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ব্রুকলিন থেকে উৎখাত হচ্ছে। ভাড়া কমাতে হবে, শিশুদের জন্য সার্বজনীন পরিচর্যা আনতে হবে, সমাজকে আরও বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। আমি প্রতিদিন লড়ব এই শহরটিকে ভালোবাসার মতো করে গড়ে তুলতে।”
তিনি আরও বলেন, “এখন আমাদের সামনে একটাই লক্ষ্য—আমাদের চলা থামানো যাবে না। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।”
নিউ ইয়র্ক শহরের বহুত্ববাদী গঠনে শাহানা হানিফের মত রাজনীতিকেরা যেন ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশি বংশদ্ভুত এক মুসলিম নারী যখন বলেন—“আমার লড়াই নিউ ইয়র্কের সকল নিপীড়িত মানুষের জন্য”—তখন তা শুধুই কণ্ঠস্বর নয়, একটি আন্দোলনের প্রতিধ্বনি।
তার জীবন, তার রাজনীতি, এবং আজকের জয়—সব মিলিয়ে শাহানা হানিফ কেবল একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি আমেরিকান গণতন্ত্রের সেই অধ্যায়, যেখানে পরিচয় নয়, মূল্যবোধই মূল। তিনি এক চলমান ইতিহাস, যিনি বাংলাদেশি অভিবাসী পরিবারে জন্ম নিয়ে আমেরিকার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছেছেন।
অভিনন্দন শাহানা হানিফ! তোমার এই বিজয় একটি অনুপ্রেরণার অগ্নিশিখা, যা ছড়িয়ে পড়বে দেশ থেকে দেশান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তুমি প্রমাণ করেছ, অভিবাসী পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়েও নেতৃত্বের উচ্চাসনে পৌঁছানো সম্ভব। তোমার এই সাহসিকতা, সংগ্রাম ও অঙ্গীকার দেখে আশাবাদী হয়ে ওঠে হাজারো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ-তরুণী, যারা স্বপ্ন দেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন, রাজনীতি, শিক্ষা ও নীতিনির্ধারণী পরিসরে নিজস্ব অবস্থান গড়ে তোলার।
আমরা সেই দিনটির স্বপ্ন দেখি, যেদিন কেবল নিউ ইয়র্ক নয়—ওয়াশিংটনের সিনেট হল, কংগ্রেস, গভর্নরের দপ্তর কিংবা হোয়াইট হাউসেও প্রতিধ্বনিত হবে আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের মূল্যবোধ। বাংলাদেশের সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।





