কানাডায় ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল: সাদা অ্যাপ্রোনের অন্তরালে

কানাডায় ক্লিনিক একটি লাভজনক ব্যবসা। দক্ষিণ এশিয় অধ্যুষিত প্রতিটি এলাকায় এসব ক্লিনিকে প্রচুর ভিড় লক্ষ্য করা যায়। শীত, গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই এই ক্লিনিক ব্যবসা জমজমাট। তুষার মাড়িয়ে, ঠাণ্ডায় জুবুথুবু হয়ে সাত সকালে লাইন ধরেন রোগীরা। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেন। সুবিধা একটা ডাক্তার মাতৃভাষায় কথা বলেন। ডাক্তার ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক সংকোচটুকুকে শ্রদ্ধা করবেন এই ভরসায়।
ঠিক এই চাহিদার ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছিল ডা. এম. এ. মান্নানের চেম্বার—মিসিসাগার এক শপিং প্লাজার পাশে, যেখানে দক্ষিণ এশিয় অভিবাসীদের নিত্য আনাগোনা। তাঁর চেম্বার সময়মতো খুলত, হাসিমুখে কথা বলতেন তিনি। কেউ কখনো সন্দেহ করেনি, এই হাসিমুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর ভগ্নসত্তা—যিনি চেম্বারের নির্জনতাকে ব্যবহার করেছিলেন নিজের খেয়ালখুশিমতো।
ডা. মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ২০১৮ সালে। কিন্তু ঘটনা ঘটে তার বহু আগে, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে। কমপক্ষে তিনজন নারী রোগী তাঁর বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ করেন—চিকিৎসা পরীক্ষার নাম করে অনুপযুক্ত স্পর্শ, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক হয়রানি।
অভিযোগকারীদের একজন বলেন, “আমি মাথা ঘোরার সমস্যা নিয়ে গিয়েছিলাম, উনি আমার পিঠ, কোমর, এমনকি বুকেও হাত রাখেন—কোনো অনুমতি ছাড়াই। বলছিলেন, এটা ‘রুটিন চেক’।”
ডা. মান্নান কেবল রোগী দেখতেন না, বরং রোগীর সঙ্গে নিজের ‘ঘনিষ্ঠতা’ গড়ে তুলতেন এমনভাবে, যেন তিনি তাঁদের দীর্ঘদিনের অভিভাবক। আর ঠিক সেই ‘আপনার মানুষ’-এর ভূমিকা থেকেই শুরু হয়েছিল ক্ষমতার অপব্যবহার।
২০১৮ সালে CPSO (College of Physicians and Surgeons of Ontario)-এর ডিসিপ্লিনারি ট্রাইবুনাল স্পষ্ট ভাষায় জানায়—ডা. মান্নান পেশাগত সীমা ভেঙেছেন, একাধিক নারী রোগীর সঙ্গে তিনি যৌন অসদাচরণ করেছেন, রোগীর আস্থার অপব্যবহার করেছেন, এবং বারবার একই ধরণের অনৈতিক আচরণে লিপ্ত হয়েছেন।
শাস্তি হিসেবে তার চিকিৎসা লাইসেন্স স্থায়ীভাবে বাতিল হয়ে যায়। সেই সাথে ১৬,২০০ কানাডিয়ান ডলার জরিমানা (তদন্ত ব্যয়ের জন্য) করা হয়। এছাড়া কানাডায় তার চিকিৎসা চর্চার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তিনি ডাক্তার হিসেবে আর কোনোদিন কাজ করতে পারবেন না।
এই রায়ের পর, কানাডার গণমাধ্যমে শোরগোল পড়ে যায়। CBC News লিখে: “Doctor stripped of license for sexual abuse of patients.”
Toronto Star তাদের প্রতিবেদনে জানায়, “একাধিক রোগীর অভিযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশালীন বার্তা এবং শারীরিক লঙ্ঘন প্রমাণ করে দেয়, এই ডাক্তারটি চিকিৎসার চেয়ে সুবিধা ভোগে বেশি আগ্রহী ছিলেন।” অথচ ডা. মান্নান ছিলেন অনেকের প্রিয় চিকিৎসক।
তিনি ছোটদের ‘বাবা’ বলে ডাকতেন, আর বাচ্চার মায়েদের ডাকতেন ‘আপা’। এই ব্যবহারের ভেতর দিয়েই তিনি তৈরি করেছিলেন এক অদৃশ্য শক্তি—রোগীরা ভেবেছিলেন, তিনি যেন পরিবারেরই একজন। এই সহজ, ঘরোয়া ডাক্তারই হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বাসভঙ্গের সবচেয়ে বেদনাদায়ক প্রতিচ্ছবি।
চিকিৎসা পেশা কেবল বিদ্যা নয়—এটি একটি নৈতিক দায়িত্ব। এই পেশার মানুষদের হাতে থাকে জীবন, মন, শরীর—তিনটিই। তাই তাদের জন্য সর্বোচ্চ সততা এবং শুদ্ধতা অপরিহার্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ক্ষমতা আর নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেলে কেউ কেউ সেই পবিত্র আস্থাকেও ব্যবহার করে নিজের কু-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে। ডা. মান্নান তেমনই একজন।
রোগীর গোপন দুঃখ, একাকিত্ব, ভাষার সীমাবদ্ধতা—এসবই হয়ে ওঠে তার হাতিয়ার। আর যখন এসব ঘটনা ফাঁস হয়, তখন কেবল এক চিকিৎসকের পতন ঘটে না—একটি পেশার ওপর থেকে সরতে থাকে বিশ্বাসের শেষ পর্দাটুকুও।
ডা. মান্নানের লাইসেন্স বাতিল হয়েছে, সংবাদমাধ্যমে তাঁর নাম এসেছে, বিচার হয়েছে। কিন্তু যে নারীরা তাঁর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁদের জীবনে সেই ক্ষত কতটুকু শুকিয়েছে, তা কি আমরা জানি?
এই ঘটনা কেবল একজন ডাক্তারের নয়, বরং এই পেশায় আরও অনেকে আছেন, যাদের বিষয় জানাজানি হয়নি। আমাদের হাতে রয়েছে আরও কিছু ডাক্তারের নাম, যাদের বিরুদ্ধে রয়েছে যৌন নিপীড়ন, পেশাগত অসদাচরণ, ওষুধের অপব্যবহার, কিংবা মিথ্যা মেডিকেল রিপোর্ট তৈরির অভিযোগ। এদের কেউ লাইসেন্স হারিয়েছেন, কেউ জরিমানা দিয়েছেন, কেউ জেলে গেছেন। আমরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি, এবং যথাসময়ে এসব ভণ্ড, বিশ্বাসঘাতকদের মুখোশ একে একে উন্মোচন করবো। সাদা অ্যাপ্রোনের অন্তরালে যারা লুকিয়ে রয়েছে, তাদের গা ঢাকা দিতে দেব না।
তথ্যসূত্র:
CPSO Discipline Decision Archive
CBC News (2018): Doctor stripped of license for sexual abuse of patients
Toronto Star (2018): Ontario doctor loses license over sexual misconduct
CanLII Legal Database: M.A. Mannan CPSO