ইসলামে গুপ্তচরের শাস্তি
ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম, যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা একটি মৌলিক নীতি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে গুপ্তচরবৃত্তি ইসলামি দৃষ্টিতে চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। ইসলামি শরিয়াহ এই অপরাধের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে।
গুপ্তচরবৃত্তি কেমন অপরাধ?
গুপ্তচর হলো এমন ব্যক্তি, যে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করে শত্রু বা বিরোধী পক্ষের হাতে তুলে দেয়। এটি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি।
কোরআন-হাদিসের দৃষ্টিভঙ্গি
আল্লাহ তাআলা গুপ্তচরবৃত্তি ও গোপন অনুসন্ধান থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন- ‘হে ঈমানদারগণ! অধিকাংশ ধারণা থেকে দূরে থাকো, কিছু ধারণা নিঃসন্দেহে গুনাহ। আর পরস্পরের গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না…।’ (সুরা হুজুরাত: ১২)
এ আয়াতে তাজাসসাসু (تَجَسَّسُوا) শব্দটি এসেছে, যার অর্থ গুপ্তচরবৃত্তি বা অন্যের গোপন তথ্য অনুসন্ধান করা। যা আল্লাহ সরাসরি নিষেধ করে দিয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘তোমরা সন্দেহ করো না, গুপ্তচরবৃত্তি করো না, একে অপরের ওপর গোয়েন্দাগিরি করো না, হিংসা করো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না…। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) আরেকটি হাদিসে নবীজি বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের গোপন বিষয় শত্রুকে জানায়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ)
নবীজির (স.)-এর সময়ে গুপ্তচরের উপযুক্ত শাস্তি হতো। সালমা ইবনুল আকওয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহর (স.) নিকট মুশরিকদের একজন গুপ্তচর উপস্থিত হলো। তখন তিনি সফরে ছিলেন। সে সাহাবিদের সাথে বসে কথা বলছিল। অতঃপর সে চলে গেল। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, তোমরা তাকে তালাশ কর এবং তাকে হত্যা কর। ফলে আমি তাকে হত্যা করলাম। তারপর তিনি তার মাল সামানা নফল হিসেবে আমাকে প্রদান করলেন।’ অপর বর্ণনামতে, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কে লোকটিকে হত্যা করেছে? লোকেরা বললো, সালামা ইবনুল আকওয়া।’ তিনি বললেন, নিহতের সব মাল-পত্র তার প্রাপ্য (আবু দাউদ: ২৬৫৩, ২৬৫৪)
খলিফাদের যুগেও গুপ্তচরের শাস্তি কঠিন ছিল। খলিফা আবু বকর (রা.) যুদ্ধ ও নিরাপত্তা ইস্যুতে বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতিতে অটল ছিলেন। তাঁর আমলে রোমান বা পারস্যের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করা ব্যক্তিদের দণ্ড দেওয়া হতো। আলী (রা.) এর আমলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যরা রাষ্ট্রীয় তথ্য পাচার করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো, যার মধ্যে কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ড দুটোই ছিল।
ইসলামি শরিয়তে গুপ্তচরের শাস্তির ধরন
ফকিহগণ বলেছেন, গুপ্তচরের অপরাধের শাস্তি অপরাধের গুরুত্ব ও ক্ষতির মাত্রার ওপর নির্ভর করে। যদি সে ইসলামি রাষ্ট্র বা মুসলিম বাহিনীর গোপন তথ্য শত্রুদের জানিয়ে দেয় এবং তা যুদ্ধ বা ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া বৈধ। আর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কম হলে বন্দিত্ব, নির্বাসন বা জেল হতে পারে।
হানাফি মাজহাবমতে, মুসলিম গুপ্তচর (যে শত্রুর জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করছে) তাকে তওবা করতে বলা হবে। যদি সে তওবা না করে এবং রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়, তবে বন্দি করা, নির্বাসন দেওয়া বা রাজদ্রোহী হিসেবে দণ্ড (যেমন মৃত্যুদণ্ড) কার্যকর করা যায়। অবশ্য এটি ইমামের ইজতিহাদ (রাষ্ট্রনেতার বিচারিক ক্ষমতা)-এর আওতায় পড়ে।
গুপ্তচর অমুসলিম হলে যদি সে চুক্তিভঙ্গ করে গুপ্তচরবৃত্তি করে, চুক্তি বাতিল করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন শত্রু হিসেবে শাস্তি কার্যকর করা যায়। তাকে ফাসাদ ফিল আরদ (পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী) বলে গণ্য করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে।
ইমাম সারাখসি (রহ.) বলেন, ‘যদি জিম্মি (অমুসলিম নাগরিক) শত্রুর পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করে, তবে তার চুক্তি বাতিল হবে এবং সে হারবি হিসেবে গণ্য হবে।’ (আল মাবসুত, খণ্ড ১০)
ইমাম কাসানি (রহ.) উল্লেখ করেন, ‘ইমামের জন্য উত্তম হবে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া যার কার্যকলাপ রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে পারে এবং সে যদি সত্যিই গুপ্তচর হয়, তবে ইমাম ইজতিহাদের ভিত্তিতে শাস্তি দিতে পারেন।’ (বাদায়েউস সানায়ি, খণ্ড ৭)
শেষ কথা, ইসলামে গুপ্তচরিতা একটি গুরুতর অপরাধ। এটি কেবল ব্যক্তি নয়, গোটা উম্মাহ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা। ইসলামি শরিয়াহ এই অপরাধে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে এবং প্রাথমিক ইসলামি যুগে, বিশেষত রাসুলুল্লাহ (স.) ও খলিফাদের সময় এই অপরাধে শাস্তি বাস্তবায়িত হয়েছে।





