মিশিগানের যে বসন্তে ঝরে গেল একটি প্রাণ
মিশিগানে বসন্ত এলে যেন প্রকৃতি নতুন গল্প লিখতে শুরু করে। দীর্ঘ শীতের বরফ জমাট রাস্তা ধীরে ধীরে উষ্ণতার ছোঁয়ায় জেগে ওঠে। গাছেদের পাতায় সবুজের ছায়া ফিরে আসে, আর সাদা চেরি ফুলের পাপড়ি বাতাসে উড়ে উড়ে জানান দেয়—প্রকৃতি থাকে উৎসবের মেজাজে। ডেট্রয়েট থেকে খানিক দূরে অবস্থিত ওয়ারেন শহরটিও তখন নতুন করে জেগে ওঠে। এখানকার ব্যস্ত রায়ান সড়কের অলিগলিতে হাঁটলে মনে হবে যেনো বাংলাদেশের কোনো ছোট্ট বাজারেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
প্রায় ষোলো বছর আগে সিলেটের বিয়ানীবাজারের সুপাতলা গ্রাম থেকে একটি পরিবার আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছিল স্বপ্ন নিয়ে। আমেরিকা মানে যেন নিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ। সেই পরিবারেরই সন্তান হোসেন আল রাজি। বয়স ১৯, স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝের এক স্পর্শকাতর বয়স। কিন্তু কে জানতো, প্রকৃতির বসন্তের সঙ্গেই ঝরে যাবে এক তরুণের জীবনের বসন্তটিও?
১২ এপ্রিল, ২০২৪। ভোরে বাবা আতিক হোসেন দুই ছেলেকে নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে বিছানায় গেলেন। সূর্যের কিরণ তখনও ঠিকভাবে জানালায় এসে পড়েনি। দুপুরের দিকে মা ও মেজ ভাই দেখলেন, রাজি কেমন যেন অস্থির। তার কথাবার্তায় অসংলগ্নতা, চোখে অন্য এক অচেনা দৃষ্টি। মুহূর্তের মধ্যে ঘরে তৈরি হলো আতঙ্ক।
বাবা আতিক ঘাবড়ে গেলেন। হঠাৎ কেন এমন আচরণ ছেলের? পরিবারটি তড়িঘড়ি আশ্রয় নিলো বাড়ির গ্যারেজে রাখা গাড়ির ভেতরে। আতিকের নির্দেশে মেজো ছেলে দ্রুত জরুরি নম্বর ৯১১-এ ফোন করল। তাদের চাওয়া ছিল শুধু অ্যাম্বুলেন্স, ছেলে যেন চিকিৎসা পায়।
কিন্তু নিয়তির নাটকীয়তার কাছে সব প্রত্যাশা তুচ্ছ হয়ে গেল।
৯১১-এ ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে অ্যাম্বুলেন্সের সাথে উপস্থিত হলো তিনজন পুলিশ অফিসার। আতিকের পরিবার গ্যারেজের ভেতর নিশ্চুপ। বাইরে তখন পুলিশ অফিসারদের চিৎকার, রাজিকে অস্ত্র ফেলে দিতে বলছে তারা। কয়েক মুহূর্ত পরেই নির্জন দুপুরের স্তব্ধতা চিরে তিন-চারটি গুলির শব্দ। গ্যারেজের ভেতর বসে থাকা পরিবারটি থমকে গেল আতঙ্কে, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে।
পরে জানা গেল, পুলিশ জানিয়েছে, তারা রাজিকে অস্ত্র হাতে দেখেছিল। পুলিশের ভাষ্য—রাজি অস্ত্র নিয়ে তাদের দিকে তেড়ে আসছিল, বাধ্য হয়েই আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানো হয়েছিল।
কিন্তু আতিক হোসেন এই ব্যাখ্যায় হতবিহ্বল। তিনি শুধু বললেন, “আমি চেয়েছিলাম ছেলের চিকিৎসা, পুলিশ এসে তাকে গুলি করলো কেন? আমার ছেলে কী এমন অপরাধ করেছিল যে তাকে জীবন দিয়ে তার মূল্য দিতে হলো?”
সেদিন বিকেল চারটায় পুলিশ জানালো হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে রাজির। সেদিন আর বসন্তের রং দেখেনি ওই পরিবার। তাদের বাড়িতে বসন্তের বদলে নেমে এসেছিল মৃত্যু আর নিঃসঙ্গতার দীর্ঘ শীত।
মিশিগানে বাংলাদেশিদের বসবাস বহু পুরনো। এখানে গড়ে ওঠা বাংলাদেশি কমিউনিটি আমেরিকার অন্যতম শক্তিশালী কমিউনিটি হিসেবে পরিচিত। তাদেরই মধ্যে বাস করেন হ্যামট্রামিকের ডেপুটি মেয়র কামরুল হাসান। রাজির মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন তিনি। স্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন তুললেন, “একটি গুলিতেই রাজি মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তবুও কেন পুলিশ আরো কয়েকটি গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করলো? এটা কী পুলিশের প্রতিহিংসা নয়?”
সেই ক্ষোভ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো পুরো মিশিগানের বাংলাদেশি সমাজে। দাবিতে উত্তাল হল কমিউনিটি, উঠে এলো পুলিশি জবাবদিহিতার প্রশ্ন। কেন এমন হলো? কেন একজন মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণের প্রতি এমন কঠোরতা দেখানো হলো?
তদন্ত হলো। কিন্তু তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতায় হারিয়ে গেল স্পষ্ট উত্তর। পুলিশের বডি ক্যামেরার ছবি প্রকাশের দাবি উঠলেও তা প্রকাশ হয়নি আজও।
পরের সোমবার রাজির দেহ হস্তান্তর করা হলো পরিবারের কাছে। ওয়ারেন শহরের ইসলামিক সেন্টারে জানাজা শেষে তাকে শায়িত করা হলো মিশিগানেরই মাটিতে। বাবা আতিকের চোখে জল ছিল না। ছিল শুধু বিস্ময়, হতাশা, অবিশ্বাস—এবং অগণিত প্রশ্নের ভার।
রাজির মৃত্যু শুধু একটি মৃত্যুই ছিল না; ছিল স্বপ্নভঙ্গের এক মর্মান্তিক অধ্যায়। এটি ছিল অভিবাসী জীবনের কঠোর বাস্তবতার নগ্ন প্রতীক। হাজারো স্বপ্ন নিয়ে আসা পরিবারগুলো যখন নিরাপত্তার জন্য পুলিশের দ্বারস্থ হয়, তখন পুলিশের বন্দুক থেকে ছুটে আসা গুলি যেন প্রশ্ন তোলে—প্রবাসের মাটিতে আমরা কতটা নিরাপদ?
রাজি নেই, কিন্তু তার স্মৃতি আজও মিশিগানের বাংলাদেশি কমিউনিটির হৃদয়ে গভীর ক্ষত হয়ে জেগে আছে। সেই বসন্ত যেন ফিরে এলেও তারা আর আগের মতো স্বপ্ন দেখতে পারে না। বসন্ত এলেই তাদের মনে করিয়ে দেয় একটি পরিবারের যন্ত্রণার গল্প, মনে করিয়ে দেয়—নিরাপত্তার প্রতীক পুলিশের গুলিতে ঝরে যাওয়া একটি প্রাণের স্মৃতি।





