সমাজসেবায় একুশে পদক পেলেন ‘দই বিক্রেতা’ জিয়াউল হক
২০০৩ সালে সারা দেশে সাংবাদিক কুররাতুল আইন তাহমিনার নেতৃত্বে সৃজনশীল উদ্যোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে একটি দল। তখনও বিশ্ববিদ্যালয় পার না করা আমি সেই দলভুক্ত। ঢাকা থেকে অ্যাসাইনমেন্ট এলো, যেতে হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকেও বেশ অনেকটা পথ, রাস্তাঘাট ভাঙা। টানা কোনও বাস যায় না। কিন্তু যেতে তো হবেই। কীভাবে যাবো, ভাবতে বসে দেখি পথ খুঁজে দেয় পথই।
রাজশাহী থেকে বাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সেখান থেকে মিশুক নিয়ে কেমন কেমন করে সেই অজপাড়াগাঁয়ে এক বাসায় হাজির হলাম। একটু বিস্কুট আর চা খেয়ে এ দোকান সে দোকানে জিজ্ঞেস করে পৌঁছাই একটি বাড়িতে। সামনে উঠোন, কিছু ছোট-বড় গাছ। আর সাদা ফতুয়া পরা একজোড়া চোখ। তিনি জিয়াউল হক। পেশায় দই বিক্রেতা। তবে কি আমরা দইয়ের ওপর ফিচার লিখতে এই ভাঙা পথ পাড়ি দিলাম? না। সেখানে জিয়াউল হকের স্ব-উদ্যোগে গড়ে তোলা পাঠাগার আছে। শুধু তাই নয়, সেসময় তিনি সাইকেল নিয়ে ঘুরে ঘুরে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ছাত্রদের বই কিনে দিয়ে সহায়তা করতেন। লাইব্রেরি কক্ষে ঢুকে আরেক দফা বিস্ময় জাগে। লাইব্রেরিতে থরে থরে সাজানো অভিধান, উপন্যাস, অনুবাদগ্রন্থ। এখানে যে কেউ এসে বই নিয়ে গিয়ে পড়তে পারে— জানিয়েছিলেন তিনি। সেই জিয়াউল হক, যার আরেক নাম জীবন ঘোষ এবার সমাজসেবায় একুশে পদক পেয়েছেন।
উপজেলার দলদলী ইউনিয়নের চামা মুশরীভুজা গ্রামের মরহুম তৈয়ব আলী মোল্লা এবং শরীফুন নেসার ঘর আলোকিত করা ছেলে মো. জিয়াউল হক। দই বিক্রি করে উপার্জিত অর্থের একটা অংশ থেকে তিনি সাধারণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর তার বাবা আর পড়াতে পারেননি। সাইকেল চালিয়ে বই বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন করেন, তার একটি অংশ দিয়ে তিনি বই কেনেন। মাধ্যমিক থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা বই কেনার সামর্থ্য রাখেন না তারা আবেদন করলে বইয়ের ব্যবস্থা করে দেন। পাশাপাশি মনের খোরাক হিসেবে নানাবিধ বই পড়তে যারা আগ্রহী, লাইব্রেরিতে এসে তা পড়ে যান।
এবারের একুশে পদকে ভূষিত হলে সবার আগ্রহ তৈরি হয় জিয়াউল হককে নিয়ে। কী করেছেন তিনি একুশে পদক পাওয়ার মতো। ভোলাহাট এত প্রত্যন্ত এলাকা ছিল, একসময় যে দিনের পত্রিকা পাঠের কোনও সুযোগ হতো না বেশিরভাগ মানুষের। দই বিক্রি শেষে বাড়ি ফেরার পথে পত্রিকা কিনে আনতেন জিয়াউল হক। আশপাশের গ্রাম থেকেও উৎসুক মানুষ তার বাসায় এসে পত্রিকা পড়তো।
যার সারা জীবনের ইচ্ছে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজের লাইব্রেরির গল্প শোনানোর, সেই তিনিই পদক পাওয়ার খবর পেয়ে ২১ তারিখ ইচ্ছেপূরণ হতে চলেছে ভেবে বিভোর। দেখা হবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর ফোন করে নাম বলতে তিনি চিনে ফেলেন। আপ্লুত হয়ে বলতে শুরু করেন সেদিনের সব কথা। তিনি জানান, এখন ৫০০ শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসের বই পাচ্ছে, আমি আনন্দিত প্রতি বছর ছাত্রদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে। এ আনন্দ কাউকে বোঝানো যাবে না। আগামী সোমবার তিনি ঢাকায় রওনা দেবেন। মানুষটি ঢাকা শহর চেনেন না, স্বজনের বাসায় উঠবেন—এটুকু জানেন বটে কিন্তু সেই এলাকা চেনেন না। হেসে বলেন, আমি ভোলাহাটের পথের মানুষ বুজি (বোন), বুঝে পাই না এ সম্মানের মান আমি কীভাবে রাখবো।





