শ্রুতি সম্মাননা পাচ্ছেন শারমিন সাথী ইসলাম ময়না
কুমিল্লার মেয়ে শারমিন সাথী ইসলাম। ময়না নামেই অধিক পরিচিত। বাবা মফিজুল ইসলাম পেশায় আইনজীবী ছিলেন। মা হাসনা ইসলাম গৃহিণী। চার বোনের মধ্যে তৃতীয় তিনি। বাবার প্রেরণায় সঙ্গীত ভুবনে যুক্ত হন। ছেলেবেলায় অলকা দাসের কাছে তার সংগীতের হাতেখড়ি। এরপর ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন থেকে নজরুল সংগীতের ওপর পাঁচ বছরের কোর্স করেন তিনি। সংগীত গুরু ওয়াহিদুল হকের সান্নিধ্যে তাঁর সংগীত প্রতিভার বিকাশ ঘটে। ১৯৯৮ সালে এ কোর্স সমাপ্ত হয়।
গুণী এই সংগীতশিল্পী ১৪২৯ বাংলার শ্রুতি সম্মাননার জন্য মনোনীত হয়েছেন। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে সাংস্কৃতিক সংগঠন শ্রুতি সিলেট প্রতিবারের মতো এবার তাকে শ্রুতি সম্মাননা প্রদান করবে।
প্রতিবছর শ্রুতি একজন করে গুণীকে এ সম্মাননা দিয়ে আসছে। বিগত বছরগুলোতে যারা শ্রুতি সম্মাননা পেয়েছেন তাঁরা হচ্ছেন- গণসঙ্গীতে প্রয়াত ভবতোষ চৌধুরী ১৪১২ বঙ্গাব্দ, কবিতায় কবি তুষার কর ১৪১৩ বঙ্গাব্দ, নজরুল সঙ্গীতে ওস্তাদ করিম শাহাবুদ্দিন ১৪১৪ বঙ্গাব্দ, লোকসঙ্গীতে প্রয়াত চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ ১৪১৫ বঙ্গাব্দ, চারুকলায় চিত্রশিল্পী প্রয়াত অরবিন্দ দাশগুপ্ত ১৪১৬ বঙ্গাব্দ, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় ড. সুরেশ রঞ্জন বসাক ১৪১৭ বঙ্গাব্দ, রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রমোদ দত্ত ১৪১৮ বঙ্গাব্দ, আবৃত্তিতে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ১৪১৯ বঙ্গাব্দ, রবীন্দ্রসঙ্গীতে ড. মকবুল হোসেন ১৪২০ বঙ্গাব্দ, ১৪২১ বঙ্গাব্দে সিলেটের বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী, কথাসাহিত্যে শাহীন আখতার ১৪২২ বাংলা, রূপা চক্রবর্তী আবৃত্তিতে ১৪২৩ বাংলায়, নীলোৎপল সাধ্য রবীন্দ্রসংগীতে ১৪২৪ বাংলায়, নজরুল সংগীতে সুজিত মোস্তফা ১৪২৫ বাংলায়, নজরুল সংগীতে সালাউদ্দিন আহমেদ ১৪২৬ বাংলায়, কবিতায় কবি হেলাল হাফিজ ১৪২৭ বাংলা এবং ১৪২৮ সালে আবৃত্তিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আবৃত্তিশিল্পী ডালিয়া আহমেদ। এ বছর ১৪২৯ বাংলার শ্রুতি সম্মাননা পাচ্ছেন গুণী নজরুল সংগীতশিল্পী শারমিন সাথী ইসলাম ময়না।
শারমিন সাথী ইসলাম ময়না বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী সুমন চৌধুরীর কাছে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত এবং নজরুল সংগীতের ওপর দীক্ষা নেন। এখনও তালিম নিচ্ছেন সুমন চৌধুরীর কাছে। সাম্প্রতিক সময়ে নজরুল সংগীতের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী শিল্পী শারমিন সাথী ইসলাম প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কাজ করছেন।
ময়না ছোটবেলায় অনেক কিছু হবেন ভাবতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতো তার ভাবনাগুলো। কিন্তু কখনও ভাবেননি নিজেকে সংগীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। কিন্তু পরিবারে নিয়মিত চর্চা হতো সংগীতের। সংগীতচর্চার ভেতর ডুবে থাকতেন তিনি। ১৯৯০ সালে ময়না আনন্দধ্বনি নামে একটি সংগঠনে যোগ দেন। যুক্ত আছেন নজরুলসংগীত সংস্থার সঙ্গে। ময়না বর্তমানে ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনে শিক্ষকতা করছেন।
তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নজরুলসঙ্গীত পরিবেশন করেন। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ও সঙ্গীত পরিবেশন করে আসছেন এ গুণী শিল্পী। অ্যালবাম ছাড়া বিভিন্ন টিভি লাইভ এবং মঞ্চেও নিয়মিত শোনা যায় তাঁর কণ্ঠ।
শুরুটা তাঁর ১৯৮৩ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে। সেবার গান গেয়েছেন তুরস্ক ও মরক্কোতে। বড় হওয়ার পর ১৯৯৮ সালে গাইতে যান ভারতে। এরপর গেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও নেপালের বিভিন্ন শহরে।
২০০৩ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে ময়নার নজরুল সঙ্গীতের এ্যালবাম ‘খুঁজি তারে আমি আপনায়’ প্রকাশিত হয়। এরপর ২০০৬ প্রকাশিত হয় নজরুল সঙ্গীতের ওপর দ্বিতীয় এ্যালবাম ‘সন্ধ্যা গোধূলি’ এবং ২০১১ সালে নজরুল সঙ্গীতের ওপর তার তৃতীয় এ্যালবাম ‘সকাল বেলার সুর’। তার সব এ্যালবাম প্রকাশ করে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন।
সংগীত গুরু ওয়াহিদুল হক এক সাক্ষাৎকারে শারমিন সাথী ইসলামকে মূল্যায়ন করেন ঠিক এভাবে- ‘…আমার জীবনে সুযোগ হয়েছে সহস্রাধিক সঙ্গীতার্থী ছেলে-মেয়েকে গানে অনেকদূর ঠেলে দেয়ার। কত যে ভাব-প্রতিভা পেয়েছি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে। কিন্তু ময়না তাদের সবার আগে। করত নজরুলগীতি, খেয়ালের প্রাথমিক স্তরের গানও কিছু। কুমিল্লায় বহু বিজ্ঞাপিত সংগীত প্রতিযোগিতায় রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগী না পাওয়ায় আটপৌরে সালওয়ার-কামিজে গান শুনতে আসা ময়নাকে জোর করে মঞ্চে তোলা হয়। গাইল ‘ওগো তুমি পঞ্চদশী’। পঙ্কজ বাবুর পরে যেন এই দ্বিতীয়বার গানটির সার্থক রূপায়ণ হলো। প্রভাতে যে প্রত্যাশা জাগিয়েছিল সে, দিন বাড়ার সঙ্গে তা যেন ক্রমেই দীপ্ততা, পূর্ণতা পেতে থাকে।
শরামিন সাথী বর্তমানে কাজ করছেন তার নতুন এ্যালবাম ‘চামেলি তোমারি চাঁদ’ এ। যার প্রতিটি গানের সুর দিয়েছেন আরেক গুণী শিল্পী হিমাংশু দত্ত। নজরুলসংগীত শিল্পী শারমিন সাথী ইসলাম আট বছর পর প্রকাশ করেছেন নতুন অ্যালবাম ‘চামেলি তোমারই চাঁদ’।
তাঁর আগের তিনটি অ্যালবামই নজরুলের গান নিয়ে করা। এবার করেছেন বিষয়ভিত্তিক গান নিয়ে যা বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রকাশ করেছে। এ বিষয় নিয়ে ভাবতে গিয়েই প্রিয় শিল্পী ময়নার সুরসাগর হিমাংশু দত্তের চাঁদ ও চামেলি বিষয়টি চলে আসে। এখানে চাঁদ হচ্ছেন হিমাংশু দত্ত নিজে। আর চামেলি তাঁর প্রেয়সী। চাঁদ ও চামেলিকে নিয়ে হিমাংশুর প্রচুর গান আছে। সেখান থেকে বিরহ-মিলনের ১০টি গান নিয়ে এই অ্যালবাম। শারমিন সাথী ইসলাম বলছিলেন ‘চামেলি তোমারই চাঁদ’ প্রসঙ্গে।
হিমাংশু দত্তের সুর করা অ্যালবামের গানগুলোর যন্ত্রানুষঙ্গ পরিচালনা করেছেন দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়। বিগত ২০১৯ সালের জুনে কলকাতায় গিয়ে চল্লিশের দশকের এই গানগুলো রেকর্ড করেন। শারমিন সাথী ইসলাম জানালেন গানগুলোর শিরোনামও— ‘রাতের ময়ূর ছড়ালো যে পাখা’, ‘নিশীথে চলে হিমেল বায়’, ‘বরষার মেঘ নামে’, ‘ঝরানো পাতার ফাঁকে’, ‘ছিল চাঁদ মেঘের পারে’, ‘ঊষার উদয় ক্ষণে’, ‘চামেলি তোমারই চাঁদ’, ‘চাঁদ কহে চামেলি গো’, ‘চাঁদ ভোলে নাই চামেলিরে’ ও ‘প্রেমের না হবে ক্ষয়’।
প্রকাশের পর থেকে গানগুলোর জন্য পরিচিতজনদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন বলেও জানালেন তিনি, এ ধরনের গান একজন শিল্পী নিজের একান্ত ভালো লাগা থেকেই করে থাকেন।
গাওয়ার পাশাপাশি ২০০০ সাল থেকে ছায়ানটে নজরুলসংগীতের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন শারমিন সাথী ইসলাম। তার আগে নিজেই সেখানে গান শিখেছেন ১৯৯৩ সাল থেকে। তাঁর স্বামী বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী বুলবুল ইসলাম।
খুব কাছ থেকেই বর্তমান প্রজন্মের নজরুলসংগীত শিল্পীদের দেখতে পাচ্ছেন শারমিন সাথী ইসলাম। তিনি বলেন, গানের প্রতি নতুন ছেলে-মেয়েদের আগ্রহ আছে। এখন তো আমাদের রিসোর্স অনেক বেশি। ইউটিউবে নজরুলের প্রচুর অপ্রচলিত গান পাওয়া যায়, রেকর্ড আছে, স্বরলিপি আছে। সবাই এ গানগুলো তুলতে চায়, শিখতে চায়। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, আজ থেকে কয়েক বছর পর আমরা নজরুলকে অন্যভাবে পাবো।