আজ পবিত্র রমজানের দ্বিতীয় জুম্মা, জুমার দিন দোয়া কবুলে সময়
আত্মশুদ্ধির মাস পবিত্র মাহে রমজান। আজ শুক্রবার (৩১ মার্চ) রহমতের ৮ তম দিন। হিজরি ১৪৪৪ সালের মাহে রমজানুল মোবারকের ২য় জুম্মা মোবারক। দেখতে দেখতে এরই মধ্যে আমাদের মাঝ থেকে রমজান মাসের ৭ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অফুরন্ত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের অমিয় বারতা নিয়ে শুভাগমন ঘটে মাহে রমজানুল মোবারকের।অপরিসীম প্রতিদান লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদত ও নেক আমলের মওসুম রমজান মাস। তারই মাঝে রমজানের জুম্মার দিনগুলি আরো বিশেষ মহিমান্বিত।এমনিতেই বলা আছে, জুম্মার দিন গরীবের হজের দিন, পবিত্র ও পূণ্যের দিন।
আজ রমজানের অন্য দিনের চেয়ে সব মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে মুসল্লিরা ধর্মীয় ভাবগাম্বির্য ও আবেগ পরিপূর্ণ। পবিত্র রমজানের আজ ০৮তম দিনে জুমার নামাজ শেষে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে দেশ ও জাতির কল্যাণসহ বিশ্ব মুসলিম উম্মার শান্তি কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হবে। রমজানের ফজিলত ও গুরুত্ব বোঝাতে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ৮৫ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেন ‘রমজান হল এ মাস, যে মাসে আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি’। এ মাসকে বরকত-রহমত-মাগফেরাতের মাস বলা হয়। এ মাসে রয়েছে শবে কদরের মত বরকতময় রাত, যা উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং যা অন্য কোন নবীর উম্মতের ভাগ্যে জোটেনি।শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ ঘোষণা হল ‘লাইলাতুল কাদরি খাইরুমম মীন আলফী শাহরিন’ অর্থাৎ শবে কদরের এক রাত হাজার মাস থেকে শ্রেষ্ঠ। রমজানের গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত হল সব মাস রোজা রাখা ফরজ।
প্রতিটি রোজায় মহান আল্লাহ পাক অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতের তালিকাভুক্ত করেন। তাই এ মাসকে বরকত-রহমত-মাগফেরাতের মাস বলা হয়। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ উম্মুক্ত করা হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। আর এ কাজগুলো রমজানের প্রতি রাতেই সংঘটিত হয় এবং শেষ রমজান পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকে। এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হল যে, জান্নাত-জাহান্নাম আল্লাহর সৃষ্ট দুইটি বস্তু, যার দরজাগুলো প্রকৃত অর্থেই খোলা কিংবা বন্ধ করা হয়।রমজানে জুমার ফজিলত: পবিত্র মাহে রমজান অফুরন্ত ফজিলতের মাস। রমজান মাসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ তারাবি, তাহাজ্জুদ, সুন্নত ও নফল নামাজ আদায়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। আর রমজান মাসে জুমাবার মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ইসলামের দৃষ্টিতে দিনটি অনেক বরকতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ এ দিনকে অন্য দিনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। পবিত্র রমজানের জুমার দিন হওয়ায় এর ফজিলত আরো অনেকগুণ বেশি।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে জুমার দিনের বহু ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।আল্লাহ তায়ালা এ দিনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর ইবাদতের জন্য দ্রুত যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বোঝ।’ সূরা জুমুআ: ০৯ হাদিসে বলা হয়েছে, আব্দুল্লাহ্ ইবনে ইউসুফ (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন জানাবত (ফরজ) গোসলের মত গোসল করে সালাতের জন্য আগমণ করে, সে যেন একটি উট কুরবানী করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ে আগমণ করে, সে যেন একটি গাভী কুরবানী করল। যে ব্যক্তি তৃতীয় পর্যায়ে যে আগমণ করে, সে যেন একটি শিং বিশিষ্ট দুম্বা কুরবানী করল। চতুর্থ পর্যায়ে যে আগমণ করে সে যেন একটি মুরগী কুরবানী করল। পঞ্চম পর্যায়ে যে আগমণ করল, সে যেন একটি ডিম কুরবানী করল। পরে ইমাম যখন খুতবা প্রদানের জন্য বের হয় তখন ফেরেশতাগণ জিকির শোনার জন্য হাজির হয়ে থাকেন।ইসলামি শরিয়তের বিধানে জুমার দিনের মাহাত্ম্য সীমাহীন। এ দিন মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদমের (আ.) দেহের বিভিন্ন অংশ সংযোজিত বা জমা করা হয়েছিল বলেই দিনটির নাম জুমা রাখা হয়েছে।
জুমার দিনকে আল্লাহ তায়ালা সীমাহীন বরকত দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। এটি সপ্তাহের সেরা দিন। হাদিস শরিফের বর্ণনা অনুযায়ী, এ বরকতময় দিনটি আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে উম্মতে মুহাম্মদিকে (সা.) দান করেছেন। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, সর্বাপেক্ষা উত্তম ও বরকতময় দিন হচ্ছে জুমার দিন। এ পবিত্র দিনে হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এ দিনে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। (মুসলিম শরিফ)এছাড়াও হাদিস শরিফে জুমার দিনকে সাপ্তাহিক ঈদের দিন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জুমা তোমাদের পারস্পরিক দেখা সাক্ষাত ও সাপ্তাহিক ঈদের দিন। তাই এ দিনটি রোজার জন্য নির্ধারিত করা সমীচীন নয়। জুমার আগের রাত্রিটিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, জুমার পূর্ববর্তী রাতে বনি আদমের সব আমল মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে পেশ করা হয়। (বুখারি, আহমদ)।
★হাদীসের ভিত্তিতে ফেকাহবিদরা এসব আমলকে নির্দিষ্ট করেছেন। যেমন, * জুমার দিন গোসল করা। যাদের ওপর জুমা ফরজ তাদের জন্য এ দিনে গোসল করাকে রাসুল (সা) ওয়াজিব করেছেন। তবে আহনাফদের মাযহাব অনুযায়ী সুন্নত। * পরিচ্ছন্নতার অংশহিসেবে সেদিন নখ ও চুলকাটা একটি ভালো কাজ। * জুমার সালাতের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার বুখারি) ৪. মিস্ওয়াক করা। (ইবনে মাজাহ) ৫. গায়ে তেল ব্যবহার করা। (বুখারি) ৬. উত্তম পোশাক পরিধান করে জুমা আদায় করা। (ইবনে মাজাহ) ৭. মুসল্লিদের ইমামের দিকে মুখ করে বসা। (তিরমিযি) ৮. পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া। (আবু দাউদ) ৯. জুম্মার দিনও জুম্মার রাতে বেশি বেশি দুরুদ পাঠ। (আবু দাউদ: ১০৪৭) ১০. এ দিন বেশি বেশি দোয়া করা। (বুখারি) ১১. মুসুল্লীদের ফাঁক করে মসজিদে সামনের দিকে এগিয়ে না যাওয়া। (বুখারি) ১২. জুমার দিনসূরা কাহাফ পড়া। পাঠকারীর জন্য আল্লাহ তায়ালা দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়কে আলোকিত করে দেন।
জুমার দিন দোয়া কবুলে সময়: জুমাবারের ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এই দিনে এমন একটা সময় আছে, যখন মুমিন বান্দা কোনো দোয়া করলে মহান আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিনে একটা এমন সময় আছে, যে সময়ে কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে তা দান করবেন। (সহীহ মুসলিম : ৮৫২, মুসনাদে আহমাদ : ৭১৫১, আস্-সুনানুল কুবরা : ১০২৩৪) জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সে মহামূল্যবান সময় কোনটা? এ সম্পর্কে ৪৫টা মতামত পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হলো, আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দোয়া কবুলের সময়। হজরত আনাস (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিনের কাঙ্ক্ষিত সময়টা হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা : ৫৪৬০, তিরমিজি : ৪৮৯)
জুমার দিনের বিশেষ দরুদ শরিফের আমল: আনাস রা. থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তোমরা জুমার দিনে বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করো। কারণ জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এইমাত্র আল্লাহতায়ালার বাণী নিয়ে উপস্থিত হলেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, পৃথিবীতে যখন কোনো মুসলমান আপনার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে আমি তার ওপর দশবার রহমত নাজিল করি এবং আমার সব ফেরেশতা তার জন্য দশবার ইস্তেগফার করে। তারগিব : ৩/২৯৯হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার ওপর দরুদ পাঠ করা পুলসিরাত পার হওয়ার সময় আলো হবে। যে ব্যক্তি জুমার দিন ৮০ বার দরুদ পড়ে তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।অন্য রেওয়াতে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন আসরের নামাজের পর নিজ স্থান থেকে ওঠার আগে ৮০ বার এই দরুদ শরিফ পাঠ করে, আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিইয়্যিল উম্মিইয়ি ওয়া আলা আলিহি ওয়া আস হাবিহি ওয়াসাল্লিমু তাসলিমা। তার ৮০ বছরের পাপ ক্ষমা হয়ে যায় এবং ৮০ বছরের ইবাদতের সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হয়।তাই জুমার দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনা করে প্রতিটি মুসলিমের উচিত দিনটিকে কাজে লাগানো। দিনটিতে মহান আল্লাহ’র ইবাদত করা এবং প্রার্থনায় নিজের ও সমগ্র মানবতার জন্য কল্যাণ-সৌভাগ্য ও উন্নতির দোয়া করা উচিত।এবং সে অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন, আমিন।